টাকার পিছনে ছোটা নয়

শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশিত: 22/02/2021   শেষ আপডেট: 04/04/2021 6:05 a.m.
@facebook BirenkBasak1

নীরব সাধনার জোরেই আজ ৫০ কোটির ব্যবসার মালিক তাঁতশিল্পী বীরেন বসাক

বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন আগেই। এ'বছর পেলেন পদ্মশ্রী সম্মান। অভিভূত তাঁতশিল্পী শ্রী বীরেন বসাক। নিজের চেষ্টায় গড়ে তোলা ৫০ কোটি টাকার উদ্যোগের সঙ্গে ৭০ বছরের এই মানুষটি আজ জড়িয়ে নিয়েছেন আরও পাঁচ হাজার শিল্পীর জীবন। এই সম্মানও তিনি ভাগ করে নিতে চান হাজার হাজার স্থানীয় তাঁতশিল্পীর় সঙ্গে যাঁদের নীরব প্রচেষ্টায় বেঁচে রয়েছে বাংলার হাতে-বোনা তাঁত-শাড়ির সৌন্দর্যমণ্ডিত গৌরবময় ঐতিহ্য। বীরেনবাবুর জীবনের কাহিনীটিও লড়াইয়ের অদ্ভূত সুন্দর নকশায় বোনা। ঠিক যেমন তাঁর হাতে তৈরি জামদানি আর টাঙ্গাইল শাড়ির মায়াময় বুনন। শোনা যাক সেই কাহিনী।

@facebook BirenkBasak1

দারিদ্র্য আর দুঃখ-কষ্টের মধ্যে ছোটবেলার শুরু

বীরেন বসাকের জন্মস্থান পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানের টাঙ্গাইল। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া দেশের অভিশাপ ছুঁয়েছিল তাঁদের পরিবারটিকেও। ১৯৬১ সালে অশান্তিবিধ্বস্ত জন্মভূমি ছেড়ে পাঁচ সন্তানের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়ায় পা রাখেন বীরেনের মা-বাবা। বীরেন তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। সহায়-সম্বলহীন উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান হিসাবে সংসারের বোঝা সেই বয়সেই তুলে নিতে হয়েছিল কাঁধে। বাবা বাঁকবিহারী বসাক তাঁতের শাড়ি বোনার স্থানীয় এক কারখানায় কাজ করতেন। সেখানে দৈনিক আড়াই টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করেন বীরেন। দেশে থাকতে বাবা ছিলেন টাঙ্গাইল ও জামদানি শাড়ির ওস্তাদ কারিগর। বংশপরম্পরায় সেই কারিগরি দক্ষতা বর্তেছিল বীরেনের মধ্যেও। ১৯৬২ থেকে '৭২– এই দশ বছর ওই কারখানায় কাজ করে তাঁতের শাড়ি বোনায় চমৎকার দক্ষতা অর্জন করেন বীরেন।

কলকাতায় পা

১৯৭২ সালে ভাই ধীরেনকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় শাড়ি বিক্রি শুরু করেন বীরেন। ভোর পাঁচটায় ঘর থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে কলকাতায় আসা। সারাদিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে, কিংবা দোকানে দোকানে তাঁতের শাড়ি ফেরি করা। শেষ ট্রেনে আবার ঘরে ফেরা। অন্ধকার রাতগুলিতে বাবা লণ্ঠন হাতে ছেলেদের জন্যে অপেক্ষা করতেন স্টেশনে। এভাবেই দিন কাটছিল গতানুগতিক। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন তাঁতের শাড়ির এক দোকানে জীবনযুদ্ধে শ্রান্ত ক্লান্ত দুই ভাইয়ের দেখা হয়ে গেল তৎকালীন সরকারের এক মন্ত্রীর স্ত্রীর সঙ্গে। তিনি বেশ কিছু শাড়ি নিয়ে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।

@facebook BirenkBasak1

কালো মেঘের ফাঁকে উঁকি দিল সুদিনের সূর্য

পরদিন সেখানে গিয়ে দুই ভাই দেখেন, ওই ভদ্রমহিলা আরও অনেককে বলে রেখেছেন শাড়ির কথা। সেদিন বিক্রি হল অনেকগুলি শাড়ি। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল খরিদ্দারের পরিধি। হাইকোর্টের বিচারপতি, সেনা-অফিসারদের স্ত্রী থেকে শুরু করে নামকরা আমলা, বুদ্ধিজীবী সহ সমাজের সামনের সারির মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছে গেল বীরেন বসাকের শাড়ি। সংসার-খরচ মিটিয়েও জমতে থাকল টাকা। ১৯৮৫-তে কলকাতারই সাদার্ন পার্কে তৈরি হল দোকান– ‘ধীরেন অ্যান্ড বীরেন বসাক অ্যান্ড কোম্পানি'।

ভাবতে হবে অন্যদের কথাও

কিন্তু তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না বীরেন। গ্রামে পড়ে আছেন আরও অনেক তাঁতশিল্পী, দু'বেলা দু'মুঠো খাবারের সংস্থান করতেই কালঘাম ছুটছে যাঁদের। তাঁদের পাশে দাঁড়াতেই হবে।

১৯৮৭-তে বীরেন ফিরে এলেন ফুলিয়ায়। আটজন তাঁতশিল্পীকে নিয়ে শুরু করলেন ‘বীরেন বসাক অ্যান্ড কোম্পানি'। টাঙ্গাইল ও জামদানি তাঁত বোনার কায়দা-কানুন শেখাতে লাগলেন তাঁদের। নিজেও ডুবে গেলেন শিল্পসাধনায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গড়ে তুললেন নিজস্ব শৈলী। টাঙ্গাইল আর জামদানির প্রথাগত বুননে লাগল নতুনত্বের ছোঁয়া। তৈরি হল নতুন নতুন নকশা। কী নেই সেখানে! প্রথাগত ডিজাইন শুধু নয়, রয়েছে রামায়ণের গল্প থেকে শুরু করে পুরাণ-কাহিনি, ইতিহাসের ঘটনা থেকে শুরু করে মনীষীদের জীবন। বহু সময় দিয়ে ধীরে ধীরে অসীম একাগ্রতায় বীরেন ও তাঁর সহযোগীরা আজও বুনে তোলেন এক-একটি শাড়ি। দাম দু'শো টাকা থেকে শুরু করে লাখখানেক পর্যন্ত।

ধীরে ধীরে নাম ছড়িয়েছে বীরেনের। দেশের ভিতরে মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, সৌরভ গাঙ্গুলী, ওস্তাদ আমজাদ আলি খান প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের মতো দেশের বাইরেও ছড়িয়ে আছেন বীরেন বসাকের তৈরি শাড়ির অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্ত। তাঁর সংস্থায় এখন কাজ করেন পাঁচ হাজার তাঁতশিল্পী। ফ্যাশন জগতে বীরেন বসাক আজ একটি উজ্জ্বল নাম।

@facebook BirenkBasak1

সফলতার পিছনে রয়েছে নীরব ও একাগ্র সাধনা

কী রয়েছে এমন অসাধারণ সাফল্যের পিছনে? চমৎকার উত্তর দিয়েছেন বীরেন। বলেছেন, ‘‘নিজেকে আমি ব্যবসায়ী নয়, একজন শিল্পী বলেই মনে করি।'' বলেছেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকে, কাজের মানের প্রতি একনিষ্ঠ থাকে, তাহলে টাকার পিছনে তাকে ছুটতে হবে না, টাকাই ছুটবে তার পিছনে''। বাস্তবে এই মানসিকতাই বীরেন বসাকের অসাধারণ লড়াইয়ের শক্তি, যা এই কঠিন সময়েও সমস্ত শিল্পীদের উজ্জীবিত করার ক্ষমতা রাখে।