স্বয়ং ইলন মাস্ক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবার থেকে গাড়ি বিক্রি করে দাম নেবেন বিটকয়েনে। সঙ্গে সঙ্গে জানুয়ারি মাসের ৪০ হাজার মার্কিন ডলার থেকে লাফ দিয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারি এক-একটি বিটকয়েনের দাম গিয়ে পৌঁছেছে ৪৮ হাজার মার্কিন ডলারের সর্বোচ্চ রেকর্ডে।
নিশ্চয়ই ভাবছেন– কে এই ইলন মাস্ক, আর বিটকয়েনই বা কী! ইলন মাস্ক হলেন, ফোর্বসের তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী, এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। ইনি ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির সংস্থা বিশ্ববিখ্যাত ‘টেসলা'-র মালিক। শুধু বিটকয়েনে বিক্রিবাটার সিদ্ধান্তই নয়, মাস্কের টেসলা কোম্পানি বিটকয়েনে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বলেও ঠিক করেছে। এই দুই সিদ্ধান্তের জেরেই বিটকয়েনের দাম এমন ভাবে আকাশ ছুঁয়েছে।
কিন্তু বিটকয়েন জিনিসটা কী?
বিটকয়েন হল এক রকমের ডিজিটাল মুদ্রা। এই মুদ্রা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর অস্তিত্ব রয়েছে শুধু ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। বোঝার সুবিধার জন্য ধরে নিতে পারেন, এ হল এক রকমের ভার্চুয়াল নগদ টাকা, যার ভিতরে আছে ব্যক্তিগত কিছু ‘কোড' বা সংকেত।
কেমন করে কাজ করে বিটকয়েন?
‘ব্লকচেন' নামে এক বিশেষ ধরনের প্রযুক্তির সাহায্যে কাজ করে বিটকয়েন। প্রতিটি বিটকয়েন হল আসলে কম্পিউটারের এক একটা ফাইল। কম্পিউটারে বা স্মার্টফোনে একটি ‘ডিজিটাল ওয়ালেট'-এ এই ফাইলগুলি সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা থাকে। এই ওয়ালেট থেকে একজন বিটকয়েন পাঠাতে পারেন আরেক জনের ওয়ালেটে, নিজেও পেতে পারেন একই পদ্ধতিতে। বিটকয়েনের প্রতিটি লেনদেন ব্লকচেনে নথিভুক্ত থাকে।
বিটকয়েন কি সরকার-স্বীকৃত?
বিটকয়েন প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থা থেকে একেবারেই আলাদা। একটি দেশের মুদ্রাব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে সে দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের। যেমন, আমাদের দেশে যে টাকার নোট ও মুদ্রা চালু আছে, তার পিছনে রয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার স্বীকৃতি। কিন্তু বিটকয়েনের ওপর কোনও দেশের সরকার বা সেখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তা সত্তে্বও যে মানুষগুলি বিটকয়েনকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে মেনে নিচ্ছেন, তাঁদের কাছে বিটকয়েন টাকা, সোনা কিংবা ধনরত্নের মতোই মূল্যবান ও বিনিময়যোগ্য। আপনিও হতে পারেন তাঁদের একজন। কিন্তু তার জন্য আপনাকে কয়েকটি জিনিস করতে হবে।
সম্পত্তি ১৫০ কোটির, নাম ফোর্বস-এর ১০০ ধনী ভারতীয়র তালিকায়
কেন এমন হল? একসময় ভারতের অন্যতম তারকা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে, ক্রমান্বয়ে তাঁর ব্যবসা ও সাম্রাজ্যের মুখ থুবড়ে পড়ার আসল কারণটা কি?
কী করে বিটকয়েনের মালিক হওয়া যায়?
১) নিজের টাকা খরচ করে বিটকয়েন কিনতে পারেন আপনি। বিটকয়েন লেনদেন করে এমন কোনও অ্যাপ ডাউনলোড করে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট যুক্ত করতে হবে সেখানে। এরপর সেটির মাধ্যমে আপনি পেতে পারেন বিটকয়েন।
২) নিজের জিনিস বিক্রি করে টাকার বদলে বিটকয়েনে দাম নিতে পারেন আপনি। এভাবে জমিয়ে ফেলতে পারেন বিটকয়েন। অথবা,
৩) ক্রিপটোকারেন্সি মাইনিং করে পেতে পারেন বিটকয়েন। এটি হল বিটকয়েন পাওয়ার সবচেয়ে কঠিন পদ্ধতি। কোডিং-এ চূড়ান্ত দক্ষতা আছে যাঁদের, একমাত্র তাঁদের পক্ষেই অত্যন্ত কঠিন সমস্ত অঙ্ক কষে ক্রিপটোকারেন্সি মাইনিং করা সম্ভব।
ক্রিপটোকারেন্সি ব্যাপারটা কী? আসুন জেনে নেওয়া যাক। তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে, কেমন করে সৃষ্টি হয়েছিল বিটকয়েনের। বলে রাখা ভাল, বিটকয়েনই হল প্রথম ক্রিপটোকারেন্সি। ২০০৯ সালে এটি তৈরি করেন সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামধারী এক প্রতিভাবান।
কীভাবে তৈরি হল বিটকয়েন?
গণিতের একটি শাখা হল ক্রিপটোগ্রাফি। দুই বা তার বেশি মানুষের মধ্যে আদানপ্রদান হওয়া তথ্যকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়, এই শাখা তারই চর্চা করে। আমরা যে ইমেল করি, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ওয়েবসাইট থেকে জিনিস কিনি কিংবা এটিএম ব্যবহার করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলি– এসব সংক্রান্ত তথ্য সুরক্ষিত রাখা হয় ক্রিপটোগ্রাফির সাহায্যে। তথ্য গোপন রাখার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছিলেন একদল বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার ও হ্যাকার। তাঁদের মনে হল, যতদিন টাকাপয়সার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকবে, ততদিন মানুষের গোপনীয়তা বলে কিছু থাকবে না। কারণ, আপনার প্রতিটি পাইপয়সা আপনি কোন খাতে খরচ করছেন, সে কথা প্রযুক্তির হাত ধরে খুব শিগগিরই জেনে ফেলবেন রাষ্টে্রর অধীশ্বররা। এ থেকেই এল এমন এক বিনিময়ের মাধ্যম তৈরির ভাবনা, যার ওপরে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তৈরি হল বিটকয়েন। ২০১০ সালে প্রথমবার বাণিজ্যিক ভাবে যাত্রা শুরু করল বিটকয়েন। সেই জয়যাত্রা থামার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বিটকয়েন কি সুরক্ষিত মুদ্রা?
যেহেতু বিটকয়েন লেনদেনের সমস্ত রেকর্ডই নথিভুক্ত থাকে, তাই জাল বিটকয়েন বানানো কিংবা অন্যের বিটকয়েন নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া কঠিন। কিন্তু এটি আদতে একটি পাসওয়ার্ড দিয়ে সুরক্ষিত কম্পিউটার ফাইল হওয়ায়, কোনও ভাবে যদি পাসওয়ার্ড হারিয়ে যায়, তাহলে নাগালের বাইরে চলে যাবে সমস্ত কিছুই। শুধু তাই নয়, বিটকয়েনের দামেরও প্রবল ওঠানামা চলে। সাধারণ মানুষের পক্ষে বিটকয়েন মাইনিংযেহেতু সম্ভব নয়, তাই নিজের গাঁটের কড়ি ভাঙিয়ে বিটকয়েন কেনা ছাড়া তাদের অন্য উপায় থাকে না। অনেকটা শেয়ার কেনাবেচার মতো করে চলে বিটকয়েনের লেনদেন। এতে অনেক সময় লোকসানের মুখে পড়তে হতে পারে। যেমন, বিটকয়েনে হঠাৎ ধস নামায় মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চনকেও ২০১৯ সালে একবার বিরাট ধাক্কা খেতে হয়েছিল। তাঁর ১০ কোটি ডলারে পৌঁছনো বিটকয়েনের শেয়ারের দাম নেমে এসেছিল ৫ কোটি ডলারের কাছাকাছি।
সাধু সাবধান!
আরেকটি বিষয়ও খেয়াল করার মতো। বিটকয়েন লেনদেনে সরকারের কোনও নজরদারি না থাকায় এখন এর পঞ্চাশ শতাংশই ব্যবহার হচ্ছে ড্রাগ কেনাবেচা, চোরাচালান আর সুপারি কিলারদের পাওনা মেটাতে। রাষ্ট্র-অধীশ্বরদের নজরদারিকে কী করে ব্যর্থ করে দেওয়া যায়, তা খুঁজতে খুঁজতেই বিটকয়েন আবিষ্কার করেছিলেন নাকামোতো ও তাঁর সাথীরা। কিন্তু সেই বিটকয়েনের এই পরিণতি নিশ্চয়ই কল্পনাও করেননি তাঁরা। ফলে ভার্চুয়াল এই মুদ্রার দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে নিজের পকেটের ময়লা নোটগুলোকে যেন আমরা হেলাফেলা না করি!