রবি-স্মরণ : ২২ শ্রাবণ কি কেবলই একটি সংখ্যামাত্র?

রাজকুমার গিরি
প্রকাশিত: 08/08/2021   শেষ আপডেট: 08/08/2021 4:46 p.m.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছবি অঙ্কনে : শিল্পী জীবস্মরণ ব্যানার্জী

আমাদের মননে চেতনায় রবীন্দ্রনাথ

নয় নয় করে রবীন্দ্রনাথ আশি বছর আগে চলে গেছেন। বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ। আর ইংরেজি অনুযায়ী ৭ অগাস্ট, ১৯৪১। তবে একজন কবির কি সত্যিই মৃত্যু হয়? তা-ও আবার রবীন্দ্রনাথের! হয় না। মৃত্যুর আশি বছর পরও রবীন্দ্রনাথ সমান প্রাসঙ্গিক সকলের মননে চেতনায়!

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন কি কেবল একটি সংখ্যামাত্র? সকালের স্নিগ্ধ আলোয় একছড়া রজনীগন্ধার মালা চড়িয়ে রবি-স্মরণ? নাকি এই দিনটায় কেবল তাঁর গান, কবিতা নিয়ে আলোচনা; টেলিভিশনের পর্দায় টক শো কিংবা খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রে কিংবা সম্পাদকীয় কলামে কেবল দুইছত্র লেখা বা পাঁচ মিনিটের একটি কবিকৃতি তুলে ধরা? এ প্রশ্নগুলো বড্ড খোঁচা দেয়! প্রশ্ন তোলে, কান্না আসে। না, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন কেবল একটা সংখ্যা নয়। রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের! প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততায়, দুঃখ-যন্ত্রনায়, আনন্দেও রবীন্দ্রনাথ।

জোর গলায় বলা হয়, বর্তমান প্রজন্ম নাকি রবীন্দ্রনাথ পড়ে না! রবীন্দ্রনাথের চিন্তাচেতনায় বিহ্বল হয়ে আত্মহারা হয় না! আদৌ কথাটা কতটা প্রাসঙ্গিক? আজও আমরা প্রিয়জনের চলে যাওয়ায় রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরি। বলি, "তুমি আছো, তাই বেঁচে আছি।" আমরা কষ্ট পেলে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজি, আর আনন্দে রবীন্দ্রনাথের দু'কলি গেয়ে উঠি ভাঙা গলায়। এই তো আমাদের রবীন্দ্রনাথ! তাই নয় কী?

এত মৃত্যুর পরও এত শক্তি কোথায় পেলেন রবীন্দ্রনাথ? দুঃখের মধ্যে মৃত্যুর মধ্যে বেঁচে থাকার বাঁচিয়ে রাখার এত শক্তি কীভাবে এল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে? জানি না। আজ অল্পতেই আমরা কাতর হয়ে পড়ি, প্রিয়জনের চলে যাওয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এত শক্তি কোথায় পেয়েছিলেন? বড্ড হিংসে হয়! রবীন্দ্রনাথ পড়তে গিয়ে তথ্য জেনেছি, একের পর এক প্রিয়জনের চলে যাওয়ার তালিকা পেয়েছি, কিন্তু অনুভব করেছি কি? দেখেছি রবীন্দ্রনাথের অসীম সহ্যশক্তির কথা!

অল্পেতেই আমরা ছেড়ে চলে যাই, কষ্ট দিই, কটু কথা বলি, প্রিয়জনের খোঁজ নিই না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এত সইলেন কীভাবে? রবীন্দ্রনাথ তো সেই সহ্যশক্তির আধার। যা আমাদের মরণের ওপারের কিংবা ছেড়ে চলে যাওয়ার মানুষের অনুভূতিগুলোকে আবার চারিয়ে তোলে! বলে, "সে আছে, কোথাও যায়নি। কেবল তুমি চোখ বন্ধ করো। দেখবে, সে আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে!"

কেবল বই পড়ে রবীন্দ্রনাথকে চেনা যায়? রবীন্দ্রনাথকে জীবন দিয়ে, অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। তাতে চেনা না গেলেও বোঝা যায়। প্রতিদিনের প্রতি কাজের মধ্য দিয়ে চিনতে হয়। ২২ শ্রাবণ কেবল একটা সংখ্যা নয় কিংবা এক মহামানবের কেবল চলে যাওয়া নয়। আমাদের আত্মার মধ্যে জাগিয়ে তোলা এক মরণের আর্তনাদের মতো অনুভূতির চোরাস্রোতে প্রিয়জনদের খোঁজা। যা একান্তই ব্যক্তিগত। যেখানে শব্দের কোলাহল নেই, নেই সেখানে উন্মাদনার আলোড়ন। আছে কেবল বন্ধ চোখে একটুখানি অশ্রুবিন্দু। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে যারা হারিয়ে যায়, তাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার দিন ২২ শ্রাবণ। আমরা যারা রোজ একটু একটু করে মরে যাই, হেরে যাই - সেখানে বাঁচতে শেখায় ২২ শ্রাবণ। তাই, ২২ শ্রাবণ চলে যাওয়ার দিন নয়, রবীন্দ্রনাথকে আরও আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার দিন। তাই তো মৃত্যুর আশি বছর পরও রবীন্দ্রনাথ আমাদের কান্নাতে থাকে, পরাজয়ে থাকে, সফলতায় থাকে। হেরে যাওয়া, জিতে যাওয়া মানুষগুলির সঙ্গী হয়ে আজও বাঁচে রবীন্দ্রনাথ।