'তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ...' হ্যাঁ, আমরা বারবার তাঁর মধ্যে হারাই এবং প্রতি মুহূর্তে তাঁকে আগের চেয়েও বেশি আত্মিকভাবে পাই! তাঁর বাইরে যে কিছু হতে পারে, সেই ভাবনার যন্তর-মন্তর থেকে আমরা বাঙালিরা বেরোতেই পারিনা! কল্লোল কবি, শ্রী অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তো বলেইছিলেন, 'সম্মুখে থাকুন বসে পথ রুধি রবীন্দ্র ঠাকুর!'
রবীন্দ্রনাথ আমাদের, 'প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি'। বাঙালির যেকোনো আবেগের নিয়ন্ত্রক তিনি। আজ, ২৫ শে বৈশাখ, বাঙালির আত্মার দোসরের 'পুজো'! অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথের ১৬১ তম জন্মবার্ষিকী! স্বভাবতই আজ প্রত্যেক বাঙালির ঘরে ঘরে হচ্ছে, 'রবি'-পুজো।
১৮৬১ সালের, ৭ মে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সারদা দেবীর কোল আলোকিত হয়ে ওঠে, 'রবি'র কিরণে! রবীন্দ্রনাথ যে আমাদের জীবনে কী, সেই বক্তব্য সহজে প্রকাশ করতে না পারাই, তাঁর অস্তিত্বের সার্থকতা! তিনি চিরটাকাল গতানুগতিকতার বিপরীতে অবস্থান করে গেছেন। তাঁর মতে, নদীর বাঁক পরিবর্তন হওয়া মানেই, 'আধুনিকতা'। আর সেই আধুনিকতার বীজকেই তিনি বপন করে গেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। এনেছেন সাহিত্যিক 'বিপ্লব'! যে যুগে দাঁড়িয়ে, নারী-মাত্রই ছিল 'পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা', অর্থাৎ সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে নারীর স্থান। সেখানে তিনি সমাজের সকল গোঁড়ামিকে ধুলিস্যাৎ করে লিখেছেন, 'চোখের বালি', 'শেষের কবিতা', 'যোগাযোগ'-এর মত কালজয়ী, দিক-পরিবর্তনকারী উপন্যাস! তাঁর সৃষ্টিতে প্রত্যেক নারী চরিত্র পেয়েছেন নিজের মুক্তির আকাশ! প্রত্যেকে সেখানে, নারীত্বের আগে, একজন পূর্ণাঙ্গ 'মানুষ' হিসেবে পরিচয় বহন করেছেন।
আমাদের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বিষাদ, ক্ষোভ সবকিছুর মধ্যেই একটি মাধুর্য ফুটে ওঠে, রবীন্দ্রনাথের জন্য! বিচ্ছেদের যন্ত্রণা নিয়েও তাঁর সৃষ্টির উদগীরণ, হয়ে ওঠে আমাদের প্রাণ শক্তি! বিচ্ছেদের মাধুর্য, বোধ হয় বাঙালি জাতি ছাড়া আর কেউ এইভাবে উপভোগ করেন না।
দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসেও তিনি প্রোজ্জ্বলমান। বঙ্গভঙ্গ রোধের গানে হিন্দু মুসলিমের মিলন বার্তা বহন থেকে শুরু করে জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজদের দ্বারা সংঘটিত, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ সরকার প্রদেয় 'নাইট' উপাধি ত্যাগ, আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত, তাঁরই লেখনিপ্রসূত। শুধু ভারতের নয়, বাংলাদেশ, এমনকি শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা, বাঙালি তথা মানব জীবনে, মহাভারতের অসীমতার মত বিস্তৃত! যাঁর শুরু নেই, শেষ নেই! আছে কেবল গ্রহণ করার মত, এক আকাশ দার্শনিকতা। তাঁর মত মহামানবের জীবনে, বিধাতাও পূর্ণচ্ছেদ যুক্ত করতে অক্ষম হয়েছেন! তিনি চিরকাল আমাদের 'প্রাণের মানুষ', তাই , 'হেরি তায় সকল খানে..'।