২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০৷ ইংল্যান্ডে আদালতের একটি ঘর৷ অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অনিল আম্বানি, এক সময়ের বিশ্বের ষষ্ঠ ধনীতম ব্যক্তি৷ ৭১ কোটি ৭০ লক্ষ ডলার ঋণ শোধ করতে না পারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে চিনের তিনটি ব্যাঙ্ক৷ হাতজোড় করে জজসাহেবকে অনিল বলছেন, তিনি নিঃস্ব৷ গয়না বিক্রি করে মামলার খরচ চালাতে হচ্ছে তাঁকে৷
ভাগ হল ধীরুভাইয়ের সাম্রাজ্য
এই দৃশ্যে এসে যেন একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল, যার প্রথম বিন্দুটি আঁকা হয়েছিল ২০০৫ সালে, যখন বাবা ধীরুভাই আম্বানির রেখে যাওয়া ২৮ হাজার কোটি টাকার ‘রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল৷ এক ভাগ– ‘রিলায়েন্স অনিল ধীরুভাই আম্বানি গ্রুপ’–এর অধীশ্বর হলেন অনিল৷ হাতে পেলেন টেলিকম, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আর্থিক পরিষেবা সংক্রান্ত ব্যবসাগুলি৷ বড়ভাই মুকেশের হাতে এল তেল শোধনাগার ও পেট্রোকেমিক্যালের ব্যবসা৷ তাঁর ব্যবসা গোষ্ঠীর নাম হল ‘রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’৷ জানা যায়, সেই সময়ে মুকেশ আম্বানির নিজের হাতে গড়ে তোলা বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণ টেলিকম ব্যবসাটি পেতে প্রবল আগ্রহ দেখিয়েছিলেন অনিল৷ দু’জনের মধ্যে টেলিকম ক্ষেত্রে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিযোগিতা না করার একটি চুক্তিও হয়৷
উজ্জ্বল সেই দিনগুলি
নভি মুম্বাইয়ের সাংবাদিক সম্মেলনে যেদিন অনিল তাঁর সাধের টেলিকম ব্যবসাটিকে ঢেলে সাজাবার কথা প্রথম ঘোষণা করলেন, সেদিন মধ্য চল্লিশের মানুষটি যেন ঝকঝক করছিলেন আত্মবিশ্বাসের উজ্জ্বলতায়, সফলতার আকাশছোঁয়া স্বপ্ণে৷ দেশ তখন মোবাইল–যোগাযোগ বিপ্লবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে৷
শুরুর দিনগুলি ছিল চমৎকার৷ দক্ষিণ মুম্বাইয়ে নিজের বাড়ি থেকে নভি মুম্বাইয়ে ‘ধীরুভাই আম্বানি নলেজ সিটি’–র মাত্র কয়েক কিলোমিটার রাস্তা হেলিকপ্ঢারে উড়ে গিয়ে অনিল একের পর এক সাংবাদিক সম্মেলন করে চলেছেন, বলিউডে ফিল্মজগতের রাজা–বাদশাদের সঙ্গে ওঠাবসা করছেন, এমনকী সমাজবাদী পার্টির নেতা অমর সিংহের মতো রাজনীতিকদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে৷ পাশাপাশি চলছে একের পর এক ব্যবসায় বিনিয়োগ৷ হলিউডের প্রখ্যাত ফিল্ম নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গের সঙ্গে জোট বেঁধে বিনোদন ব্যবসা করেন অনিল৷ ২০০৫ সালে সাড়ে তিনশো কোটি টাকায় অ্যাডল্যাবস মাল্টিপ্লেক্স চেন কেনেন৷ দেশ–বিদেশের ৭০০টি সিনেমা–স্ক্রিন কিনে হয়ে ওঠেন সবচেয়ে বড় মাল্টিপ্লেক্স মালিক৷ সবচেয়ে বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগগুলি তিনি করেন মূলত বিদ্যুৎ ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে৷ ২০০০–এর দশকে গৌতম আদানি, রুইয়া, টাটা–র মতো শিল্পপতিরা এইসব ক্ষেত্রে টাকা ঢালছিলেন৷ দেখাদেখি অনিলও ২০০৮, ’০৯ সালে সরকারের নিলাম করা তিনটি প্রধান মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প কিনে নেন৷ তাঁর রিলায়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার রেল, রাস্তা ইত্যাদি প্রকল্পে টাকা ঢালতে থাকে৷ এই সময়েই ফোর্বসের তালিকায় বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বোত্তম ধনী হিসেবে নাম ওঠে ৪২শো কোটি ডলারের মালিক অনিল আম্বানির৷
ঘনিয়ে ওঠা অন্ধকার
এরপরই আস্তে আস্তে ঘনিয়ে উঠতে থাকে অন্ধকার৷ ২০০৮ সালে আমেরিকায় ‘লেম্যান ব্রাদার্স’–এর পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে আসে অর্থনৈতিক মন্দা৷ ব্যবসাপত্রের হাল খারাপ হতে থাকে৷ এই সময়ে দ্বিতীয় দফার ইউপিএ সরকারের শেষের দিকে টু–জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির কারণে অনিলের ২ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প আটকে যায়৷ অভিযুক্ত টেলিকম মন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে অনিলকেও পড়তে হয় সিবিআই তদন্তের মুখে৷ এরপর কে–জি বেসিন তৈলক্ষেত্রের গ্যাসের দাম নিয়ে অনিল বড়ভাই মুকেশের সঙ্গে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন৷ মুকেশের মালিকানার এই তৈলক্ষেত্র থেকে অনিলের প্রস্তাবিত দাদরির বিদ্যুৎ প্রকল্পে গ্যাস সরবরাহের কথা ছিল৷ ২০১০–এ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গ্যাসের দাম স্থির করার ভার দেওয়া হয় সরকারকে৷ পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে শেষ পর্যন্ত অনিল জমি ও গ্যাস পাওয়া নিয়ে সমস্যার অজুহাতে দাদরি প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসেন৷
ইতিমধ্যে ২০১০–এর মে মাসে দুই ভাইয়ের মধ্যেকার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুকেশ আম্বানি ঝাঁপিয়ে পড়েন টেলি–যোগাযোগ ব্যবসায়৷ উন্নত ৪–জি প্রযুক্তি ও প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার দীর্ঘ ফাইবার অপটিক লাইন নিয়ে ২০১৬–র অক্টোবরে ‘জিও’–র প্রবেশ অনিল আম্বানি সহ টেলি–যোগাযোগ ক্ষেত্রের অন্য খেলোয়াড়দের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়৷ ধসে পড়তে থাকে অনিলের গর্বের রিলায়েন্স–কমিউনিকেশ্ বা আর–কমের সাম্রাজ্য৷ আর ধীরে ধীরে এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তির স্থান দখল করেন বড় ভাই মুকেশ আম্বানি৷
সম্পত্তি ১৫০ কোটির, নাম ফোর্বস-এর ১০০ ধনী ভারতীয়র তালিকায়
জমে ওঠা ঋণের পাহাড়
টেলিকম ব্যবসায় ক্ষতির পাশাপাশি অন্য ক্ষেত্রগুলিতেও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়ে ধার শোধ করতে সম্পত্তি বেচে দেওয়া ছাড়া অনিলের অন্য পথ খোলা থাকল না৷ তাঁর রিলায়েন্স পাওয়ারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প কাঁচামালের অভাবে নিষ্ক্রিয় পড়ে থাকে৷ ২০১৫–তে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যে ব্যবসা অনিল শুরু করেছিলেন, তাকে ঘিরেও বিতর্ক ঘনিয়ে ওঠে৷ রাফালে যুদ্ধবিমান কেনায় অনিলের সঙ্গে বেআইনি লেনদেনের অভিযোগ ওঠে৷ এদিকে অনিলের ব্যবসা–গোষ্ঠীর দেনা ক্রমাগত বাড়তে থাকে৷ ২০১৮–র সেপ্ঢেম্বরে তা পৌঁছয় ১ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকায়৷ ফলে অনিল কখনও শেয়ার, কখনও বা গোটা সংস্থাটাই বেচে দেওয়ার পথ ধরেন৷ একে একে বিক্রি হতে থাকে রিলায়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রিলায়েন্স এন্টারটেনমেন্টের মাল্টিপ্লেক্স চেনগুলি৷ এতেও কমেনি ঋণের বোঝা৷ এখন চিনের তিনটি সরকারি ব্যাঙ্কের বিপুল ঋণ মেটাতে না পারায় ইংল্যান্ডের আদালতে তাঁর বিচার চলছে৷
কেন এমন হল ?
অনিল আম্বানির চমকপ্রদ উত্থান ও তার পর ক্রমান্বয়ে তাঁর ব্যবসা–সাম্রাজ্যের মুখ থুবড়ে পড়া নিয়ে মানুষের মনে প্রবল কৌতূহল আছে৷ কেন এমন হল? অনিলের সংস্থাগুলি কি ব্যবসাজগতের স্বাভাবিক টানাপড়েনের সাথে টক্কর দিতে পারল না, নাকি সেগুলি পরিচালনার ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি ছিল৷ ওয়াকিবহালরা বলেন, দুটো কারণই সত্য৷ বলেন, লাগামছাড়া উচ্চাকাঙক্ষার কারণে অনিল অনেকগুলি বৃহৎ ব্যবসা হাতে নিয়েছিলেন, যার কোনওটিকেই আয়ের প্রধান উৎস হিসাবে গড়ে তুলতে পারেননি৷ পরিকল্পনাহীন ভাবে ক্রমাগত বাণিজ্য–সাম্রাজ্য বাড়িয়ে তুলতে গিয়ে বিপুল ঋণের দায়ে হাবুডুবু খেয়েছেন৷ টেলিকম ক্ষেত্রে প্রযুক্তি বেছে নিতে ভুল হয়েছিল তাঁর৷ এর পিছনে রয়েছে দূরদৃষ্টির অভাব৷ বিপরীতে বড়ভাই মুকেশ আম্বানি মূল ব্যবসাগুলির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ধীরে ধীরে ব্যবসার ক্ষেত্র বাড়িয়েছেন৷ অনেকে অনিল আম্বানির এই দুঃখজনক পরিণতির জন্য তাঁর অগভীর মানসিকতা, বিলাসবহুল জীবনের প্রতি আকর্ষণ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের দিকে আঙুল তুলেছেন৷
যাই হোক অনিল আম্বানির উত্থান ও পতন ব্যবসায়িক জগতের মানুষের কাছে অনেক দিন পর্যন্ত আলোচনার অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে৷ আশা করা যায়, তাঁর শিল্পসাম্রাজ্যের পতন থেকে শিক্ষা নেবেন আগামী দিনের উদ্যোগপতিরা৷