"যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও, তবে স্বামী বিবেকানন্দকে জানো"— কবিগুরুর এই আপ্তবাক্য হোক আধুনিক যুব সমাজের মূল লক্ষ্য

সুকন্যা রায়
প্রকাশিত: 12/01/2021   শেষ আপডেট: 04/04/2021 6:27 a.m.
স্বামী বিবেকানন্দ (১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ - ৪ জুলাই ১৯০২)

ব্যস্ত সময়, ব্যস্ততর যুগ, ব্যস্ততম যুব সমাজ... ছুঁটে চলেছে লক্ষ্যহীন, দিকভ্রান্ত হয়ে। আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে। এই "বিষ-ময়" সময়েও যিনি আশ্রয়, পথপ্রদর্শক, তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর বাণী, তাঁর আদর্শই হোক আমাদের যুব সমাজের ঐক্য সঙ্গীত।

"এই পৃথিবীতে যখন জন্মগ্রহণ করেছ, তখন কিছু স্থায়ী কীর্তি রেখে যাও। অন্যথা প্রস্তর ও বৃক্ষসমূহ থেকে তোমার পার্থক্য কোথায়!..বস্তুতঃ তাদেরও অস্তিত্ব আছে, তারাও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং তাদেরও বিনাশ ঘটে।"― আজকের আলোচনাটা শুরুই করলাম স্বামী বিবেকানন্দের এই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে। বর্তমান যুগ তথা এই সময়টা বড়ই অস্থির। যুবসমাজও দিকভ্রষ্ট, প্রত্যেকের মধ্যেই যেন Identity crisis চলছে, সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে স্বামীজির এই বাণী, তাঁর চিন্তা আমাদের নতুনভাবে ভাবতে শেখায়, মনে করায়, আমরা তো মনুষ্য জাতি, 'জগতের মহাশক্তি' তো আমাদেরই মধ্যে, তবে এই অস্তিত্বহীনতা কেন? যতদিন নিজেদের আমরা পরাজিত, দুর্বল, ভীরু ভাববো, ততদিনই আমরা নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে ভুগবো। আজকের যুবসমাজকে এই দুর্বলতা পরিত্যাগ করে স্বামীজির আদর্শকে শিরোধার্য করতে হবে―"সাহসী হও। সত্যকে জেনে, তা জীবনে পরিণত করো।"

By Unknown author - http://www.vivekananda.net/photos/America%201893%201895/America1893-1895.html, Public Domain, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=18667766

"বড় হতে গেলে 'আমি'কে নয়, 'আমরা'কে আশ্রয় করো..."― এই শিক্ষা ছোট থেকেই আমরা বঙ্গ সন্তানরা পেয়ে আসি। এর কারণ আমাদের মাথার ওপর সর্বদা বটবৃক্ষের মতো আমরা পেয়েছি এমন মহামানবদের, যাদের কাছে 'মনুষ্যত্ব'ই সবচেয়ে বড় ধর্ম। আজন্ম যাঁরা 'ত্যাগ ও সেবা'র আদর্শকে বহন করেছেন। তাঁদের মধ্যে এক নক্ষত্র হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। জন্মের সার্ধ-শতবর্ষ পেরিয়েও যিনি সমুজ্জ্বল আমাদের মনে, চেতনায়, কর্মে, ভাবে, শিক্ষায় ও সংস্কারে। রবি ঠাকুরের ভাষায়, "ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারই হউক জয়.."।

আজকের এই সময় বড়ই অস্থির, চঞ্চল। আজকের যুবসমাজ নানাদিক থেকে বারংবার হেরে গিয়ে নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। বেকারত্ব তাদের আত্মবিশ্বাসে হানছে আঘাত। এই সময়ে স্বামীজির সেই আহ্বানই হতে পারে যুবসমাজকে উদ্দীপিত করার মন্ত্র―"যে নিজেকে বিশ্বাস করেনা, সেই নাস্তিক।" অতএব, "সিংহ-গর্জনে আত্মার মহিমা ঘোষণা কর...Arise! Awake! And stop not till the goal is reached"... না, থামলে চলবে না। এগিয়ে চলাই যে জীবন, সেই মন্ত্র তিনি দিয়েছেন। বলেছেন, বাধা এলেও থামা চলবে না, পিছনে ফেরা যাবে না, 'অহং' এর ওপর থেকে বিশ্বাস হারালে চলবে না―"অগ্রসর হও, পশ্চাতে চাহিও না। এগিয়ে যাও সম্মুখে।"

স্বামীজী বিশ্বাস করতেন, এই যুবসমাজই দেশ তথা জাতির ধারক, বাহক, সঞ্চালক। তাই, নিজেরা শিক্ষাগ্রহণ করার পাশাপাশি অন্যকেও শিক্ষাদান করতে হবে। শুধু 'আমি'তে আবদ্ধ থাকলে চলবে না। বললেন―

"আগে নিজের পায়ে উপর দাঁড়াও, তারপর সকল জাতির নিকট হইতে শিক্ষা গ্রহণ কর, যাহা কিছু তোমার কাজে লাগিবে, তাহা গ্রহণ কর। তবে, একটি কথা মনে রাখিও.. তোমরা যাহা কিছু শিক্ষা গ্রহণ কর না কেন, তাহাই যেন তোমাদের জাতীয় জীবনের মূলমন্ত্রস্বরূপ..."

যে যুবসমাজের ওপর একটি সমাজের, জাতির, দেশের তথা জগতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে, সেই যুবসমাজের শিক্ষা গ্রহণ পরিপূর্ণ ও সঠিক হওয়া উচিত, এ কথা স্বামীজী বিশ্বাস করতেন। তিনি জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, যুবসমাজের শিক্ষাগত ত্রুটিই তাদেরকে বিচ্ছিন্ন, দুর্বল, ঔদ্ধত্যপূর্ণ করে তোলে। সমাজে বাঁচতে গেলে সকল কর্মজীবী মানুষের অবদানই যে গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই যুবসমাজের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের বিপরীতে সঠিক শিক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। যে শিক্ষা সাহস দেবে, বল দেবে, সেই শিক্ষাই হোক প্রকৃত শিক্ষা― "যে বিদ্যার উন্মেষে ইতর-সাধারণকে জীবন সংগ্রামে সমর্থ করিতে পারা যায় না, যাতে মানুষের চরিত্রবল, পরার্থপরতা, সিংহ-সাহসিকতা এনে দেয় না, সে কি আবার শিক্ষা? যে শিক্ষায় জীবনে নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারা যায়, সেই হচ্ছে শিক্ষা।" সেই শিক্ষাই হোক কাম্য, যে শিক্ষা যুবসমাজকে দেবে শক্তি-সাহস-বল-উৎসাহ-বিশ্বাস-মনুষ্যত্ব। কারণ, শিক্ষা দ্বারা অর্জিত যে শক্তি, সুখ আর আনন্দ, তাইই দেবে "অনন্ত ও অবিনশ্বর জীবন।"

আমাদের জাতির তথা দেশের সামাজিক ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে কুসংস্কার, তা স্বামীজিকে ব্যথিত করেছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের যুবসমাজই পারে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এই কুসংস্কারের অচলায়তন ভেঙে ফেলতে। পরানুকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। দেশের সেবায় এগিয়ে আসতে বারংবার যুবসমাজকেই তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন; বলেছিলেন―

The end of all education, all training should be man making

তিনি বিশ্বাস করতেন, যেকোনো মানুষ যদি প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, তবেই তার মন থেকে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস দূর হবে, সর্বোপরি চরিত্র গঠিত হবে।

By Parliament of Religion, 1893 - http://www.vivekananda.org/archivedphotoslideshow.asp?id=32, Public Domain, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=5512251

"ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই আনন্দ"― এই মন্ত্রও তিনিই দিয়েছেন। এই উন্নয়নশীল দেশে 'ধর্ম' নিয়ে আজও লড়াই, বিভেদ। আধুনিকতার বড়াই করতে গিয়ে আসল ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এই দুনিয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর সেই দৃপ্ত আহ্বান মনে পড়ে..."ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দেওয়াই একমাত্র ধর্ম, আর সব অধর্ম"। তরুণ যুবসমাজকে তিনি আরও একবার তাদের কর্তব্য সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, "জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।"

আজকের এই কর্ম চঞ্চল সময়ে যারা শুধু নিজেদের কথাই ভাবতে ব্যস্ত, উত্তোরত্তর চাহিদা বৃদ্ধিতে নিজেরাই লক্ষ্যহীন, তাদের সেই মানসিকতায় তাঁর এই আহ্বান যেন কুঠারাঘাত। চারপাশের অন্ধকার, অবক্ষয়, দুরাচার, ভ্রষ্টাচারের মাঝে তাঁর সেই বাণী হোক আধুনিক যুবসমাজের অনুপ্রেরণা― " নিরাশ হইও না; পথ বড় কঠিন―যেন ক্ষুরধারের ন্যায় দুর্গম; তাহা হইলেও নিরাশ হইও না; উঠ-জাগো এবং তোমাদের চরম আদর্শে উপনীত হও।"


ঋণ স্বীকার―

  • স্বামীজির চিত্র ও বাণী, রামকৃষ্ণ মন্দির লোকশিক্ষা পরিষদ, রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, নরেন্দ্রপুর, কলকাতা।
  • আদিগন্ত পত্রিকা, ২০১৩ সংখ্যা(বেথুন কলেজ)