গত প্রায় দেড় বছর ধরে আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। Covid-19, পাশাপাশি এ বছর গরমও মাত্রা ছাড়া। ছোটরা স্কুল বা খেলার মাঠ, কোথাও যেতে পাচ্ছে না। আর বড়রা কেউ হয়তো কাজে বেরোচ্ছেন, কেউ বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছেন। কিন্তু, নিজেদের স্বাস্থ্যের দিকে খোঁজ রাখছেন কি? এই সময় প্রয়োজন পরিমিত ও সুষম আহার। তারই সন্ধান দিলেন ডায়েটিশিয়ান অনুশ্রী মিত্র। কথা শুনলেন পরিদর্শকের পক্ষ থেকে সুকন্যা রায়।
প্রশ্ন — প্রায় গত দেড় বছরে এই কোভিডের পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি শিশুরা, এই অবস্থায় তাদের কী কী ডায়েট ফলো করা উচিত বা তাদের অভিভাবকরা কীভাবে তাদের খাদ্যতালিকায় নজর দেবেন সেটা যদি বলেন..
উত্তর — আমাদের অভিভাবক দের মনে রাখতে হবে যে যতদিন ছোটরা ঘরবন্দি আছে, তাদের কিন্তু অ্যাক্টিভিটি লেভেল অনেক কমে গেছে আগের থেকে। তাই তাদের আগে যে খাদ্য তালিকা ছিল সেটা যদি এখনও ফলো করা হয় তাহলে কিন্তু সমূহ বিপদ।
অ্যাক্টিভিটি লেভেল কমে যাওয়ায় আগে যে খাদ্য তালিকা আমরা অনুসরণ করতাম সেটা কিন্তু আর করা যাবে না। আর যদি আগের মতোই আমরা করতে থাকি অর্থাৎ বাচ্চাদের সমপরিমাণ খাবার এখন দিতে থাকি তাহলে কিন্তু ছোটরা ওয়েট গেন করবে । ফলে চাইল্ডহুড ওবিসিটি হতে পারে। ফিউচারে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। সুতরাং আমাদের অভিবাবকদের খুব সতর্ক থাকতে হবে এই সময়ে শিশুদের ডায়েট চার্ট এর বিষয়ে। বারবার খাবে কিন্তু অল্প অল্প করে খাবে এবং নিউট্রিশিয়াস খাবারের দিকে অভিভাবকদের মন দিতে হবে। খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে পরিমাণমতো সবজি , সিজনাল সব ধরনের ফল পাশাপাশি দুগ্ধজাত প্রোডাক্ট। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন তারা ফ্রোজেন ফুড (ফ্রিজে রাখা স্পাইসি বা অতিরিক্ত ক্যালরির খাবার) অভিভাবকদের আড়ালে খেয়ে না ফেলে।
প্রশ্ন — তবে ম্যাম ,এখন একটা সমস্যা যে; বাচ্চারা সারাক্ষণ যেহেতু ঘরবন্দি প্রায় দেড় বছর ধরে... তাদের মন বা মেজাজ ভালো রাখতে অনেক সময় অভিভাবকরা কিছু স্পাইসি ফুড অর্ডার করে ফেলছেন বা তাদের খাওয়াচ্ছেন, সেদিকটা নিয়ে আপনি কি বলবেন?
উত্তর— দেখুন স্পাইসি ফুড বাচ্চারা খেতেই পারে কিন্তু স্পাইসি মানে এই নয় যে স্টোর করা কোন জাঙ্কফুড বা হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার দিয়ে কোন খাবার বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে। অভিভাবকরা বাড়িতেও তৈরি করে দিতে পারেন কোনো স্পাইসি খাবার। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তাদের জাঙ্ক ফুড বা স্পাইসি ফুড খাবার বিষয়ে খুব অতিরিক্ত প্রশ্রয় না দিয়ে আমরা যদি একটা সঠিক ডায়েট বাচ্চাদের জন্য ফলো করি আর মাঝে মাঝে যদি ওদের পছন্দ মতন খাবার তৈরি করে দি, তাহলে দুদিকই বজায় থাকবে। ওদের শরীর আর মন দুটোই ভাল থাকবে।
প্রশ্ন—এবার আসি বড়দের কথায়। এখন যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়ার্ক ফ্রম হোম; তবু অনেককেই বাইরে যেতে হচ্ছে বিশেষত যারা এমারজেন্সি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে বাইরে যেতে হচ্ছে।একদিকে প্রচন্ড গরম, তারপর কোভিড।এই সময় কী ধরনের ডায়েট ফলো করা যেতে পারে?
উত্তর—দেখুন ডায়েটের কথা যখন বললেন তখন প্রথমেই বলি যে এই যে প্রচন্ড গরম এবং ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তাতে কিন্তু জল খাওয়াটা খুবই প্রয়োজনীয় এবং জল হিসাবে এমনি জল তো খাবেনই পাশাপাশি ডাবের জল, পুদিনা পাতার জল, লস্যি এগুলো খুব প্রয়োজনীয়। এবার বলি, খাদ্যের কথা।যারা বাইরে বের হচ্ছেন তাদের জন্য হেলদি ব্রেকফাস্ট কিন্তু খুব খুব জরুরী এবং ব্রেকফাস্ট খুব দরকারী এই কারণে যে সারাদিনের যে এনার্জি সেটা কিন্তু আমরা ব্রেকফাস্ট থেকে পাই। "পরিমিত ব্রেকফাস্ট"টা জরুরী এবং যারা কাজে বের হচ্ছেন এবং সঙ্গে যারা কিছু খাবার ক্যারি করছেন সেখানে এমন কিছু খাবার থাকবে যেগুলো সহজপাচ্য; সহজে হজম হবে এবং পাশাপাশি আমাদেরকে আমাকে এনার্জি দেবে ,আমাদের পেট ভরাবে। খাদ্যতালিকায় যেন পরিমিত সবজি এবং ফল থাকে। আরেকটা কথা ভীষণভাবে জরুরি যে, হেলদি ফুড এর দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সেটা কনফ্লেক্স হতে পারে ,সেটা স্পাউস হতে পারে বা ফ্রুট স্যালাড হতে পারে এবং সকালবেলা মৌরির জল খাওয়া—এইগুলো আমাদের অভ্যাস করতে হবে।
প্রশ্ন—কোভিডের পরিস্থিতিতে বিশেষ কোনো ডায়েট চার্ট ফলো করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর—দেখুন, কোভিডের জন্য আমি বলতে পারি যে , ভিটামিন সি জাতীয় খাবার সেগুলো কিন্তু আমাদের ডায়েট চার্টে ইনক্লুড করা ভীষণ দরকার। সব সময় হেলদি খাবার টা খুব জরুরী কারণ গরমকালে এমনি সহজপাচ্য ও হালকা খাবারের পরামর্শ আমরা দিয়ে থাকি, প্লাস এই মহামারী পরিস্থিতিতে আমরা বলবো যে হেলদি ডায়েট চার্ট কিন্তু ফলো করা খুব জরুরি। খিদে পেলে স্টোর করা কোন খাবার খেয়ে নিলাম বা কিছু অর্ডার দিয়ে দিলাম বা কোন স্পাইসি ফুড খেলাম বা খুব ঝাল মশলা দেওয়া কোন খাবার খেলাম, যেগুলো হয়তো মুখে ভালো লাগছে কিন্তু সেগুলো শরীরে খুব সাংঘাতিক এফেক্ট করছে। তাই, আমাদের এই পরিস্থিতিতে মাথায় রাখতে হবে ভিটামিন সি, ভিটামিন ই জাতীয় খাবার এবং খাদ্য তালিকায় প্রচুর পরিমাণে ফল বিশেষ করে এই ফলগুলো আমরা কিন্তু রাখতে পারি, যেমন— আমলকি,আমলকির জুস বা পেয়ারা বা পাকা পেঁপে। আর সবজির মধ্যে এমন সবজিগুলো রাখবো যেগুলো খুব ইজিলি ডাইজেস্ট হয়ে যায়। আর রেগুলার আমাদের ডায়েট চার্টে যেন টকদই থাকে; এটা কিন্তু ম্যান্ডেটরি। এছাড়াও হলুদ আমরা দুধে মিশিয়ে খেতে পারি । তবে যাদের ডাইজেশনের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে বরণ করবো দুধ খেতে যে ।কিন্তু যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে দুধের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটা আমরা বড়রা খেতে পারি এবং বাচ্চাদেরও খাওয়াতে পারি। অর্থাৎ,অর্গানিক কাঁচা হলুদ, সেটা দুধে মিশিয়ে আমরা সকালে বা সন্ধ্যেবেলায় নিজেরাও খেতে পারি বাচ্চাদেরও খাওয়াতে পারি। যখন আমরা লাঞ্চ করছি সেই সময়টা আমরা কাঁচা রসুন খেতে পারি বা সকালবেলা মধুতে রসুন খেতে পারি।এগুলো যদি ডায়েট চার্টে এখন ইনক্লুড করা যায় খুবই ভালো হয়। ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রসুন কিন্তু ভীষণ কার্যকরী।
প্রশ্ন— যারা কোভিড পেশেন্ট, তাদের ১৪ দিনের আইসোলেশনে থাকতে হচ্ছে ,এমতাবস্থায় তাদের কী ডায়েট চার্ট ফলো করতে হবে সেটা যদি বলেন...
উত্তর— খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে চা বানিয়ে খাওয়া যাদের অভ্যাস, সেটা বাদ দিতে হবে, পরিবর্তে যেটা খুব দরকার সেটা হচ্ছে "কারা" বানিয়ে খাওয়া। জলে তুলসি পাতা, আদা ,মৌরি, জিরা দিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে আমরা এটা বানাতে পারি। তারপর জলটাকে ছেঁকে নিয়ে তাতে লেবুর রস দিয়ে আমরা খেতে পারি। তার পাঁচ মিনিট বা দশ মিনিট বাদে আমরা কিছু ড্রাই ফুটস খেতে পারি। এই সময়ে যেটা হয় যে, খাবার ইচ্ছেটা বা রুচি থাকে না;সেই জন্য আমরা কিছু হেলদি ড্রাই ফুটস সাজেস্ট করছি। আমন্ড বা ভেজানো ছোলা অথবা চিয়া সিডস এগুলো কিন্তু খাওয়া যেতে পারে। ব্রেকফাস্টটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং যদি হাই ফিবার থাকে তাহলে হাই ক্যালরিযুক্ত খাবার খেতে হবে বা হাই কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার খেতে হবে।ব্রেকফাস্টে রুটি রাখা যেতে পারে, সবজি রাখা যেতে পারে। সাধারণভাবে যেগুলো বলছিলাম যে, ফল(পাকা পেঁপে, পেয়ারা, মুসম্বি লেবু) খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।আমরা যে খাবারটা খাব , সেটা যেন হেলদি হয়।যেমন, রুটি ও সবজি-তরকারি খাব। বা চিঁড়ের পোলাও বাদাম দিয়ে এগুলো খেতে পারি। ভিটামিন সি, ভিটামিন ই এবং ভিটামিন এ যুক্ত ফলকে গুরুত্ব দেব। আমলকি এবং পাকা পেঁপে ডায়েটে রাখতে হবে। লাঞ্চে ভাত ডাল মাছ তরকারি যে রকম হয় সেরকমই খাব। একটা রসুন রাখার পরামর্শ দেবো লাঞ্চের সঙ্গে। তারপরে ডায়েট চার্টে দই রাখতে হচ্ছে। সন্ধ্যেবেলা খুব হালকা কিছু খাবার , সেটা যেন খুব লাইট হয়। আবার রাতে হালকা কিছু খাবার খেয়ে নেওয়া। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই সময়ে রেস্টে থাকতে হয়, সেক্ষেত্রে সহজে হজম হয়ে যায় সেরকম খাদ্য,তালিকায় আমাদের রাখতে হবে।
পরিশেষে বলব সকলে খুব ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন এই বিশ্রী সময়টা আমরা একদিন নিশ্চয়ই পেরিয়ে যাব কিন্তু আমাদের নিজেদেরকে খেয়াল রাখতে হবে ,আমাদের পরিবারের সকলের জন্য আমাদের নিজেদেরকে ভালো থাকতে হবে ।তাই সুষম খাদ্য তালিকা মেনে এবং অবশ্যই "পরিদর্শক" এর সঙ্গে থাকুন।