আপামর বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হলো দুর্গাপূজো। আজও যেদিন ভোরে পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র -এর যুগলবন্দির সৃষ্ট, আকাশবাণী কলকাতার বিশেষ অনুষ্ঠান 'মহালয়া'-র ধ্বনিতে বাঙালিদের ঘুম ভাঙে, সেটি হলো মহালয়ার ভোর। এই পুন্য তিথিতে সমগ্র ভারতবাসী পিতৃ-পুরুষকে জল তর্পণের মধ্যে দিয়ে দেবী দুর্গার মহা পূজো ও নবরাত্রিতে ব্রতী হন। জেনে নেওয়া যাক মহালয়ার কথাটির অর্থ কি? অথবা, পিতৃপক্ষের শেষ বা দেবীপক্ষ শুরুকে 'মহালয়া' বলা হয় কেন?
‘মহ’ শব্দটির দুইটি অর্থ আছে। ‘মহ’ বলতে বোঝায় পূজা, আবার ‘মহ’ বলতে বোঝায় উৎসব। আবার মহালয় বলতে বোঝায় মহান + আলয় = মহালয়। তার সঙ্গে স্ত্রীকারান্ত’ আ। মহালয় হচ্ছে পূজা বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। আন্যদিকে ‘মহালয়’ বলতে, ‘পিতৃলোককে’ বোঝায় -যেখানে বিদেহী পিতৃপুরুষ অবস্থান করছেন। তা যদি হয় তাহলে পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানই মহালয়া। কিন্তু তাহলে স্ত্রীলিঙ্গ হল কেন? পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা পেরিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করি, তখনই সেই মহা লগ্নটি আমাদের জীবনে ‘মহালয়ার’ বার্তা নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরণের লগ্নটির নাম মহালয়া।
মহাভারতে প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে ও তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। কর্ণ দেবরাজ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে দেবরাজ বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃ-পুরুষদের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই স্বর্গে তাঁকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তাঁর পিতৃ-পুরুষদের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃ-পরুষদের স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে।
আমাদের অনেকেরই অজানা মহালয়ার পরেরদিন অর্থাৎ আশ্বিন শুক্লা প্রতিপদ থেকে বহু মঠ-মন্দির থেকে শুরু করে বহু বনেদি বাড়িতে পূজো আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর থেকে প্রতিদিনই চলতে থাকে পূজো-অর্চনা, চন্ডীপাঠ ইত্যাদি। পঞ্চমীর সন্ধ্যাতে বেলগাছের মূলে হয় দুর্গা দেবীর বোধন, ষষ্ঠীতে দেবীর আমন্ত্রণ-অধিবাস ও সপ্তমীতে কলাবউ বা নবপত্রিকা স্নানের মধ্যে দিয়ে শুরু করে দুর্গাপূজো চলতে থাকে দশমীর দর্পন বিসর্জন, অপরাজিতা পূজো পর্যন্ত। তবে এই বছর ভাদ্রমাসে দুটি অমাবস্যা তিথি পড়ায় আগামী ভাদ্র সংক্রান্তিতে মহালয়া হলেও, শাস্ত্র অনুযায়ী আশ্বিন মাস মলমাস তাই দুর্গা পূজোও একমাস পিছিয়ে কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
মহালয়া আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের অকাল বোধনকে কেন্দ্র করে। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে স্ত্রী সীতাদেবীকে উদ্ধারের জন্য। আসল দুর্গা পূজো হলো বসন্ত কালে, যা বাসন্তী পূজো নামে খ্যাত। কিন্তু আশ্বিন মাসে সূর্যের দক্ষিণায়ন চলার ফলে সকল দেবী ও দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই শ্রীরামচন্দ্রকে দেবী পূজোর উদ্দেশ্যে মহাদেবীর বোধন বা জাগরণ করতে হয়েছিল। তাই এই আশ্বিন মাসের পূজো 'অকাল বোধন' নামে পরিচিতি লাভ করে। শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী যে কোনো শুভ কাজের আগে নিজ নিজ পিতৃপুরুষদের সাথে সাথে সকল জীব জগতের কল্যাণের উদ্দেশ্যেও শ্রাদ্ধ বা তর্পণ করতে হয়। তাই ভগবান শ্রীরামচন্দ্রও এই পুন্য তিথিতে তার পিতৃ-পুরুষ ও সমস্ত বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় তর্পণ করেছিলেন এবং তারপর তিনি দুর্গা দেবীকে আবাহন করেছিলেন। সেই তর্পণের দিনটিই পিতৃপক্ষের শেষ দিন বা মহালয়া।