২১ ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। বিশ্বের ইতিহাসে কেবল ভাষার জন্য লড়াই করে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষায় প্রাণ দিয়েছেন - এ ঘটনা বিরল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ এদিনে নিজেদের মাতৃভাষার জন্য আনন্দ, আবেগে ভেসে ওঠেন ঠিকই, তবুও গোটা ঘটনার সঙ্গে যেহেতু বাংলা ভাষার ঘনিষ্ঠ সংযোগ, তাই বাঙালি হিসেবে গর্ব তো হয়-ই। কেবল গর্ব নয়, বরং চাপা এক ধরণের শ্লাঘা অনুভব করি।
এই গর্ব কি কেবল একদিনের জন্য? নাকি আজন্ম বাঙালি এই গর্ব-মদিরায় ডুব দিয়ে থাকেন? বাঙালিদের বলা হয় হুজুগে জাতি! ওই কোন একটা দিবস পেলেই উদযাপনের অন্ত্য নেই। এদিন বাঙালি মেতে উঠবেন সেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের চিরস্মরণীয় গান নিয়ে - "আমি বাংলায় গান গাই!" হয়তো কেউ কেউ চোখের জল আটকাতে পারবেন না! বলবেন, "উফ! কী প্যাথেটিক সং!" কিংবা শামসুর রহমানের কবিতা আওড়াবেন। গলগল করে মুখস্থ বলে যাবেন, "তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।" আর দিনশেষে বলবেন, "ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায় - কথায় হাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।" (ভবানীপ্রসাদ মজুমদার)
ভাষা তো উত্তরাধিকার, ভাষা তো ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। মানুষের কাজের ভাষা কিংবা পড়াশোনার ভাষা যাই হোক, নিজের মাতৃভাষার প্রতি আনুগত্য থাকবে না, শ্রদ্ধা থাকবে না - এ কেমন কথা! এই তো আজকের ট্রেন্ড! বাংলা বলতে হবে চিবিয়ে চিবিয়ে, আর ইংরেজিটা চোস্ত। আর হিন্দি হলে তো কথাই নেই! নাহলে 'স্টেটাস' বজায় থাকে কী করে! ভাষা তাই আজ নিজেদের ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় কচকচে ইংরেজি, হিন্দির পাশে বাংলা তাই অচ্ছুত, নিতান্তই 'ব্যাকডেটেড'। অসুবিধে নেই ইংরেজি, কী হিন্দিতে। ভাষা তো বহমান। কিন্তু যখনই অপরাপর ভাষাগুলো তুলনায় গুরুত্বহীন কিংবা 'শিখব কেন' এমন মানসিকতা, সেখানেই তৈরি হয় দ্বন্দ্ব।
অথচ এই বাংলা ভাষা নিয়েই লড়াই হল, প্রাণ দিল কত তরতাজা যুবক। তৈরি হল স্বাধীন একটি দেশও। এ লড়াই এ বঙ্গে হয়নি। হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে, আজকের বাংলাদেশে। ১৯৪৭-এ দেশভাগ, জন্ম হল পূর্ব পাকিস্তানের। বাংলাভাষী কয়েক কোটি মানুষের উপর নেমে এল ভাষার কুঠারাঘাত। জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার দুষ্ট-চক্র ছড়িয়ে পড়ল সেদেশ জুড়ে। শুরু হল গণআন্দোলন। প্রতিবাদ, প্রতিরোধে মানুষ সামিল হলেন। প্রাণের মায়া ত্যাগ করলেন। কিন্তু এ তো কেবল ভাষার জন্য লড়াই নয়, এরসঙ্গে জড়িয়ে পড়ল বাঙালির অস্তিত্ব সঙ্কটের লড়াই, নিজ সংস্কৃতি রক্ষার প্রাণপণ সংগ্রাম।
বলা হয়, "মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সমান", সেই মাতৃদুগ্ধে কেউ থাবা বসালে প্রতিবাদ তো হবেই। কিন্তু শাসকের দম্ভ থামে না, বরং দিনদিন শাসকের রক্তচক্ষু আরও প্রবল হল। জোর করে বাঙালির উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার দুষ্ট চক্রান্ত করল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। মুদ্রার নোট, স্ট্যাম্প থেকে জোরপূর্বক বাংলা ভাষাকে সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ শুরু হল। একদিকে শাসকের রক্তচক্ষু, অপরদিকে নিজ মাতৃভাষা রক্ষার লড়াই - উভয়ে মিলে তৈরি হল বারুদের স্ফুলিঙ্গ। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৈরি হল ইতিহাস। ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন একদল তরুণ তর্কী। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর-সহ আরও অগণিত পড়ুয়ার আত্মবলিদানে তৈরি হল নতুন ইতিহাস। ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন তাঁরা। শাসকের রক্তচক্ষু সাময়িকভাবে স্তব্ধ হলেও আগ্রাসন কমেনি। আজও চোরাস্রোতের মতো বহমান। আজও মাতৃভাষার গুরুত্ব ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু।
যে ভাষায় মানুষ সহজ, স্বচ্ছন্দ - তাই হোক কাজের ভাষা, পড়াশোনার ভাষা, হৃদয়ের ভাষা। চাপিয়ে দেওয়া নয়, আগ্রাসন নয়, মনের আনন্দে মানুষ ভাষার চর্চা করুক। কেবল কয়েকটি ভাষার আধিপত্য নয়, প্রতিটি ভাষার প্রতি থাকুক সমান আনুগত্য। ভাষা হোক মুক্ত, স্বাধীন, হৃদয়স্পর্শী।