চিরঘুমন্ত পম্পেই নগরী আজও পর্যটকদের অমোঘ আকর্ষণের কেন্দ্র
পাওয়া গেল দু’হাজার বছরের পুরনো দেহাবশেষ
ইটালির আর্কিওলজিকাল পার্কে প্রাচীন পম্পেই নগরীর ধ্বংসস্তূপে কিছুদিন আগেই খুঁজে পাওয়া গেল দুটি মানুষের পাথর হয়ে যাওয়া দেহাবশেষ৷ তিন বছর আগে এখানেই পাওয়া গিয়েছিল আস্তাবলে বাঁধা লাগাম পরানো তিনটি ঘোড়ার প্রস্তরীভূত অবিকৃত শরীর৷
এসব আবিষ্কারে চোখের সামনে যেন খুলে যায় হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের হলদে হয়ে যাওয়া পাতা৷ আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ভিসুভিয়াস যেন মাথা তোলে তার সর্বগ্রাসী ভয়াল রূপ নিয়ে৷ সজীব হয়ে ওঠে ইতিহাস–নগরী, মৃতদের শহর পম্পেই৷ কানে যেন ভেসে আসে বেঁচে থাকতে চাওয়া আতঙ্কিত মানুষের তীব্র আর্তনাদ আর হাহাকার৷ তারপর? শুধুই স্তব্ধতা৷ চোখের পলকে একটা গোটা শহরের, তার যাবতীয় সৌন্দর্য, সাজসজ্জা, প্রাণচঞ্চলতা সমেত, একটা পাথরের মডেলের মতো নিশ্চুপ রহস্যময় পড়ে থাকা– যে রহস্য ধীরে ধীরে উন্মোচন করবে ভবিষ্যতের মানুষ৷
সে আজ প্রায় দু’হাজার বছর আগেকার কথা৷ এখনকার দক্ষিণ ইটালিতে ছিল অতীতের পম্পেই নগর– সে যুগের রোমান ধনীদের অবসর যাপনের মনোরম আবাস। দিনটি ছিল ৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর৷ অন্যদিনের মতোই সেদিনও ছিল ভিড়ে ভরা রাস্তায়, বাজারে কর্মব্যস্ত মানুষের ভিড়৷ দুপুরের দিকে হঠাৎ ভীষণ আওয়াজে কেঁপে উঠল মাটি৷ উৎস খুঁজতে গিয়ে বিস্মিত নাগরিকরা দেখল দূরে পাহাড়ের চূড়া থেকে বেরিয়ে আসছে আগুন আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী৷ ছড়িয়ে পড়ছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে৷ জেগে উঠেছে আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস। ছাইয়ের মোটা স্তর আর ধোঁয়া সেদিন ঢেকে দিয়েছিল সূর্যকেও৷ দুপুরবেলাতেই নেমে এসেছিল অন্ধকার৷ আতঙ্কিত দিশাহারা মানুষ কেউ পালিয়েছিল পম্পেই শহর ছেড়ে, কেউ বা আশ্রয় নিয়েছিল ঘরের ভিতরে৷ কিন্তু বন্ধ হয়নি পাহাড় থেকে গরম ছাইয়ের ক্রমাগত গড়িয়ে নেমে শহরের দিকে এগিয়ে আসা৷ ধীরে ধীরে পম্পেই শহরে জমে ওঠে পোড়া ছাইয়ের স্তূপ৷ সেই স্তূপ কোথাও কোথাও উঁচু হয়ে ওঠে নয় ফুট পর্যন্ত৷ ঢেকে যায় ঘরের বাইরে বেরোবার সমস্ত দরজাও৷
মাঝরাতে আরও একবার আগুন উদগীরণ করে মাউন্ট ভিসুভিয়াস৷ প্রচণ্ড উত্তপ্ত ছাই, গলে যাওয়া পাথরের স্রোত বিষাক্ত গ্যাসের সঙ্গে মিশে আগ্নেয়গিরি বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে৷ গরম লাভা ঘন্টায় ১৮০ মাইল বেগে ধেয়ে আসতে থাকে পম্পেই শহরের দিকে৷ পথে যা কিছু পড়ে সমস্ত চলে যায় সেই উত্তপ্ত লাভাস্রোতের গ্রাসে৷ পরদিন সকালের মধ্যে গোটা পম্পেই শহর সম্পূর্ণ ঢেকে যায় ছাই ও পাথর মিশ্রিত লাভায়৷
পৃথিবীর বুক থেকে এভাবেই মুছে গেল পম্পেই, পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে৷ কিন্তু সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে অবিকৃত চেহারা নিয়ে থেকে গেল গোটা শহর৷ নিজের নাগরিক ও তাদের বিচরণভূমিগুলিকে সযত্নে বুকে আঁকড়ে রয়ে গেল মৃতনগরী পম্পেই৷ ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে জমে যাওয়া লাভার স্তরের আবরণ ঢেকে রেখে দিল এই শহরের সমস্ত বাড়িঘর, শিল্পস্থাপত্য এমনকি মানুষ ও পোষা জন্তু–জানোয়ারের মৃত শরীরগুলিকেও– নষ্ট হতে দিল না৷ দীর্ঘদিন এভাবেই পড়ে ছিল রোমান নগরী পম্পেই, মানুষের চোখের আড়ালে৷
১৭৪৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে এই হারিয়ে যাওয়া নগরীকে আবার আলোর মুখ দেখালেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা৷ এখনও শেষ হয়নি তাঁদের কাজ৷ আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে পম্পেইয়ের ইতিহাস ইতিমধ্যে অনেকটাই আবিষ্কার করা গেছে৷ জানা গেছে, এই পম্পেই ছিল ধনী রোমানদের ছুটি কাটানোর প্রিয় শহর৷ সুন্দর সাজানো সেই শহরে বাঁধানো রাস্তার দু’ধারে ছিল চওড়া ফুটপাত৷ কাদা বাঁচিয়ে চলার জন্য পাথরের সারি সাজানো ছিল সেখানে৷ ছিল সর্বসাধারণের ব্যবহারের স্নানাগার৷ গ্ল্যাডিয়েটরদের বীরত্ব কিংবা রথের প্রতিযোগিতা দেখে অবকাশ বিনোদনের জন্য ছিল অ্যাম্ফিথিয়েটার৷
সেই পম্পেইয়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে দুটি দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়ার কথা জানালেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা, ২২ নভেম্বর৷ তাঁদের অনুমান, দেহদুটি এক ধনী ব্যক্তি ও তার অনুচর দাসের৷ খনন চালাতে গিয়ে যেখানে এগুলি পাওয়া গেছে, সেটি কোনও ধনী রোমানের বিলাসবহুল প্রাসাদ ছিল বলেই মনে করছেন গবেষকরা৷ চিৎ হয়ে কাছাকাছি শুয়ে থাকা পাথর হয়ে যাওয়া শরীরদুটির ওপরে জমে ছিল অন্তত সাড়ে ছ’ফুট উঁচু ধূসর ছাইয়ের স্তর৷ বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে গবেষকরা জানিয়েছেন, বলিষ্ঠ চেহারার দেহটি সম্ভবত ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়স্ক্ কোনও ধনী যুবকের৷ অপর দেহটি সম্ভবত ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যেকার কোনও তরুণের৷ মেরুদণ্ডের হাড়ের গঠন লক্ষ করে গবেষকদের ধারণা, তরুণটি সম্ভবত ছিল ক্রীতদাস, যাকে নিয়মিত কঠিন শারীরিক পরিশ্রম করতে হত৷
দেহাবশেষদুটি পাওয়া গেছে প্রাসাদটির নিচে যাতায়াত করার ভূগর্ভস্থ পথের পাশের একটি ঘরে৷ যাতায়াতের এই পথগুলিকে প্রাচীন রোমে বলা হত ‘ক্রিপটোপোর্টিকাস’৷ ইটালির আর্কিওলজিকাল পার্কের ডাইরেক্টর, প্রত্নতত্ত্ববিদ মাসসিমো ওসান্না জানিয়েছেন, আগ্নেয়গিরির ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে এই দু’জন সম্ভবত মাটির নিচের ক্রিপটোপোর্টিকাস–এ আশ্রয় খুঁজেছিল, ভেবেছিল সেখানে তারা নিরাপদ৷ কিন্তু ৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর সকালে ভিসুভিয়াসের জ্বলন্ত লাভাস্রোত পম্পেইতে ধেয়ে এসে যাবতীয় সবকিছুকে ধ্বংস করে দিয়েছিল৷ রক্ষা পায়নি এই দুটি মানুষও৷
আজও পম্পেই নগরী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্র৷ আগামী দিনে গবেষকরা নিশ্চয়ই মৃতনগরী পম্পেইয়ের রহস্যের পর্দা আরও বেশি করে উন্মোচন করবেন৷