শুধু আইন করে দলিত নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না, পাল্টাতে হবে গোটা সমাজ মনন

শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশিত: 10/10/2020   শেষ আপডেট: 11/10/2020 8:15 p.m.

দরিদ্র পিছিয়ে পড়া দলিত সমাজের মানুষ মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে সেই 'বাড়াবাড়ি'র শাস্তি হিসাবে ধর্ষণের অস্ত্র বেছে নেয় উচ্চবর্ণের ধনী পুরুষেরা।

বেপরোয়া বেড়ে চলা ধর্ষণ নির্যাতনের এই দেশে নারীর বেঁচে থাকা, ভাল থাকা এমনিতেই কঠিন৷ দরিদ্র দলিত মেয়েদের কাছে তা কঠিনতর।

বেড়ে চলেছে অত্যাচারিতের সংখ্যা

দলিত মহিলাদের ওপর অত্যাচার এ দেশে আজ দৈনন্দিনের ঘটনা৷ হাথরসের দলিত নির্যাতিতার মৃত্যুর ২৪ ঘন্টার মধ্যে উত্তরপ্রদেশেই আরেক দলিত তরুণীর ধর্ষণ ও মৃত্যু হয়েছে৷ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো–২০১৯–এর রিপোর্ট– দেশে প্রতিদিন প্রায় দশজন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ সংখ্যাটা নিশ্চয়ই আরও বেশি, কারণ সব ঘটনায় থানায় অভিযোগ জমা পড়ে না।

অমানবিক বর্বরতা

শুধু ধর্ষণেই কি নৃশংসতার শেষ? হাথরসে দুষ্কৃতীরা মেরে হাড় ভেঙে দিয়েছে মেয়েটির, কেটে নিয়েছে জিভ। গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। মৃতপ্রায় শরীরটাকে হাসপাতালের সাধারণ বেডে সাত দিনেরও বেশি ফেলে রাখা হয়েছিল। ১৪ দিন লড়াই করে দিল্লির হাসপাতালে তরুণীর মৃত্যুর পর উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের পুলিশ-প্রশাসন সর্বশক্তি নিয়ে লেগে গিয়েছিল ধর্ষণ হয়নি একথা প্রমাণ করতে। খবর প্রকাশ্যে এসে যাওয়ায় চার ধর্ষণকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল ঠিকই, কিন্তু অপরাধীর শাস্তি নয়, তাদের লক্ষ্য ছিল ঘটনার মুখ ঘোরানো। শেষে প্রমাণ লোপাট করতে পরিজনদের ঘরে আটকে রেখে রাতের অন্ধকারে পুলিশ পুড়িয়ে দেয় মৃতদেহ। বুঝতে অসুবিধা হয় না উচ্চবর্ণের ধর্ষণকারীদের বাঁচাতে উপরমহলের রাজনৈতিক চাপেই এই তৎপরতা। এও পরিষ্কার যে এর পিছনে রয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের দল বিজেপির ভোটের হিসেব। তাই গোটা দেশ যখন এই ঘটনায় ধিক্কার জানাচ্ছে তখন এক প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক উচ্চবর্ণের ধর্ষণকারীদের সমর্থনে সভা পর্যন্ত করেছেন হাথরসে।

রাষ্ট্রের চোখে গরিব দলিতরা মানুষই নয়

অর্থাৎ দলিত কন্যার ওপর এই জঘন্য বর্বরতা ও তার মৃত্যু দাগই কাটেনি সে রাজ্যের সরকারি নেতা-মন্ত্রী ও প্রশাসক-পুলিশদের উপর। কারণ এদেশের সমাজমননে গেড়ে বসে থাকা পুরুষতন্ত্র ও উচ্চবর্ণের আধিপত্যবাদ দলিতদের মানুষ বলেই মনে করে না। ধর্ষণ তাদের কাছে আধিপত্য ফলানোর একটা অস্ত্র। দরিদ্র পিছিয়ে পড়া দলিত সমাজের মানুষ মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে সেই 'বাড়াবাড়ি'র শাস্তি হিসাবে ধর্ষণের অস্ত্র বেছে নেয় উচ্চবর্ণের ধনী পুরুষেরা। সংবিধানের ১৭ নম্বর ধারায় দলিতদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য যতই শাস্তির বিধান থাকুক খোদ রাষ্ট্রই উঁচু জাতের অত্যাচারীর পাশে এসে দাঁড়ায়, আইনের ধার ধারে না। জানা গেছে হাথরসেও ধর্ষণকারীদের সঙ্গে মৃত দলিত মেয়েটির পরিবারের পুরনো বিবাদ ছিল।

শুধু জাতপাত নয় আর্থিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ

এদেশের পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলিতে এই ধরনের ঘটনার পিছনে জাতপাত, দলিত- উচ্চবর্ণ সম্পর্ক ইত্যাদি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ দলিতদের অর্থনৈতিক অবস্থান। দলিত সমাজের অধিকাংশ মানুষই আর্থিক দিক থেকে অত্যন্ত পিছিয়ে। সেই কারণেও সমাজে তাদের স্থান নিচে। প্রতিবাদের সামর্থ্য তাদের নেই-- এ কথা জেনেই উচ্চবর্ণের মানুষ ও তাদের পেটোয়া পুলিশ-প্রশাসনের এত অত্যাচার।

স্বয়ং ভারতের রাষ্ট্রপতিও একজন দলিত

এই অবস্থা ঘোচাতে দলিত উত্থানের কথা বলছেন একদল। কিন্তু জাতের ভিত্তিতে লড়াই করে কি এ সমস্যার সমাধান সম্ভব? স্বয়ং ভারতের রাষ্ট্রপতিও কিন্তু দলিত সমাজের মানুষ। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট যেমন কালো মানুষের ওপর সেদেশের শ্বেতাঙ্গ পুলিশের অত্যাচার বন্ধ করতে পারেননি, তেমনি এদেশের দলিত রাষ্ট্রপতি কিংবা হাতে গোনা কিছু দলিত শ্রেণীভুক্ত ধনী শিল্পপতি বা রাজনৈতিক নেতা নিজেরা এগিয়ে থাকলেও গোটা দলিত সমাজের দুরবস্থা ঘোচাতে পারবেন না। এর জন্য চাই মানুষে মানুষে আর্থিক বৈষম্যের অবসান। পাশাপাশি চাই আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারের মধ্যে দিয়ে জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতার মানসিকতা দূর করা। চাই নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। সেই কাজে এগিয়ে আসতে হবে গোটা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে। তা না হলে বিশ্বের কাছে ভারতের মাথা নিচু করে দিয়ে একের পর এক হাথরস-কাণ্ড ঘটতেই থাকবে।