ফুল পছন্দ করেননা, এমন মানুষ মেলা ভার! বিভিন্নরকম ফুলের প্রতি আকর্ষিত হয়ে, মানুষ সেগুলি সংরক্ষণ করেন। কিন্তু, অসমের মিঠু গগৈ (Mithu Gogoi) ফুল তথা প্রকৃতি-প্রেমী তো বটেই, বলা বাহুল্য যে, তিনি তাঁর বাড়িতে ফুল ভালোবাসেন বলে যে তা সংরক্ষণ করে রাখেন শুধু এমনটা নয়, বরং তিনি বন্য ফুলের গাছগুলিকে বিভিন্ন দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে তাদের পরিত্রাতা হয়ে উঠেছেন। বিভিন্ন বন্য দুর্যোগ, আগুন লাগা, গাছ কাটা, নতুন বাসস্থান নির্মাণের জন্য বনের প্রতি যে অত্যাচার চলে, এই সকল প্রতিকূলতার হাত থেকে তিনি বন্য অর্কিড গাছগুলিকে রক্ষা করেছেন। এর ফলে তাঁর সংরক্ষিত অর্কিডের সাম্রাজ্যে, নয় হাজারটিরও বেশি ফুল ফোটে প্রতি বসন্তে।
বসন্তকালে, তাঁদের বাড়ি, জোড়হাটের টিটাবরে প্রায় চল্লিশজন মত 'অতিথি' প্রতিদিন গাছ দেখতে আসেন। কিন্তু অসমের জনপ্রিয় উৎসব, 'বিহু'র সময়ে এই সংখ্যাটি শতাধিক গুন বেড়ে যায়! প্রায় চারশো জন দর্শনার্থীকে আপ্যায়ন করতে হয় মিঠু গগৈ এবং তাঁর স্ত্রী বন্টি গগৈকে (Bonti Gogoi)।
এই দর্শনার্থীরা কিন্তু তাঁদের আত্মীয় অথবা বন্ধুবান্ধব বৃত্তের আয়ত্তে নন। তাঁরা বেশিরভাগই পর্যটক, অথবা ছাত্র। যাঁরা ব্যাক্তিগত অর্কিড সংগ্রহ দেখতে উৎসাহী হন। এক একরেরও কম জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই বাগানটি মিঠু গগৈয়ের পৈতৃক বাড়ি সংলগ্ন। অর্কিড ফোটার সময় হল এপ্রিল মাস। এই সময় তাঁর বাগানটি স্বর্গ-রাজ্য হয়ে ওঠে।
মিঠু গগৈ একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন, অর্কিড প্রায় অনেক বন থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অসমের বন থেকে তো নব্বই শতাংশের বেশি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাই এই মিষ্টি-মধুর ফুলটির আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তাঁর কর্তব্য ছিল, জীবিত গাছগুলিকে নিয়ে সংরক্ষিত করা। আজ তাঁর সেই মানবিক চিন্তাধারাই, বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
অর্কিড ফুলের কিছু প্রজাতি যেহেতু বিপন্ন এই মুহূর্তে, তাই সেইগুলি ব্যাক্তিগত ভাবে সংরক্ষণ করার পক্ষে বেআইনি। কিন্তু মিঠু নিশ্চিন্ত করেছেন, তাঁর সংরক্ষণের সকল ফুলগুলিই আইনি ভাবে সংরক্ষণের উপযুক্ত।
মিঠু জোড়হাটের একটি সাতচল্লিশ জন সদস্য সংখ্যার গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, যাঁদের উদ্দ্যেশ্য অর্কিডকে সংরক্ষণ করা। এই দল উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অর্কিড গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, প্রায় শতাধিক বিপন্ন গাছ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়াও, রাস্তার পাশে অসুরক্ষিত গাছ দেখলে, তাঁরা তা উদ্ধার করে হয় নিরাপদ প্রকৃতির মাঝে ফিরিয়ে দেন, অথবা নিজেদের ব্যক্তিগত সংরক্ষণের অংশীদার করেন।
মিঠু গগৈয়ের এই অর্কিড যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সাল থেকে, যখন তাঁদের পারিবারিক জমি, চা বাগান নির্মাণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য পরিদর্শন করার ফলে, তাঁর মধ্যে অর্কিড-প্রীতি জন্মায়। সেই চা বাগানের জন্য নির্বাচিত বাগানে, তিনি অর্কিডের চারা রোপণ করেন।
গাছ পালন, শিশুপালনের তুলনায় কোন অংশে কম নয়। মিঠু জানিয়েছেন, একজন শিশুর মতই তিনি তাঁর গাছেদের যত্ন নেন, লালন পালন করেন। সময় মত জল দেওয়া, গোড়া ছাঁটাই করা, সার দেওয়া, সবকিছুই অতি স্নেহবৎসল 'পিতা'র মতই সংঘটিত করেন তিনি।
বিভিন্ন সমাজ বিশেষজ্ঞরা মিঠুকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সঙ্গে তাঁরা সকলেই প্রতিটি মানুষের উদ্যেশ্যে পরামর্শ দিয়েছেন, মানুষ যেন প্রকৃতির ব্যাপারে ঔদাস্য প্রকাশ না করে থাকেন, প্রকৃতিই মানুষের রক্ষাকর্তা, আর তাঁর প্রতিই মানুষ বিরূপ আচরণ পোষণ করে থাকেন। এই আচরণটিই বদলাতে হবে। তবেই একটি সুস্থ সবল, সহিষ্ণু পৃথিবী তৈরি হয়ে উঠবে।