বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে চলে শীতের দাপট৷ তাপমাত্রা কখনও কখনও নেমে যায় শূন্যের কুড়ি ডিগ্রিরও নিচে৷ টানা দু’মাস ধরে দেখা মেলে না সূর্যের৷ কিন্তু তাতে কী! এত প্রতিকূলতার মাঝেও বারবার তিনবার বিশ্বের সুখীতম দেশের খেতাব ধরে রেখেছে ফিনল্যান্ড৷
২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ বা ‘বিশ্ব সুখ রিপোর্ট’ প্রকাশ করে রাষ্ট্রসংঘ৷৷ বিভিন্ন দেশে মানুষের গড় আয়ু কত, জীবনের নানা বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে কিনা তাঁদের, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার কত, দেশে দুর্নীতির হাল কেমন ইত্যাদি বিষয়ে সমীক্ষা চালানো হয়৷ পাশাপাশি, মানুষ নিজেদের জীবনে সুখী কি না– তাও প্রশ্ন করে জেনে নেন সমীক্ষকরা৷ এরই ভিত্তিতে তৈরি হওয়া রিপোর্টে ২০১৮ থেকে ২০২০– পরপর তিন বছর পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ বলে চিহ্নিত হয়েছে ফিনল্যান্ড৷
কল্পনা নয়, বাস্তব
আচ্ছা, একবার ভাবুন তো যদি এমন হত– দেশে কোনও মানুষেরই খাওয়া–পরার অভাব নেই৷ রোজগার কম হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সরকার৷ অসুখ–বিসুখে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া নিশ্চিত৷ সন্তানের পড়াশোনার জন্যও চিন্তা নেই, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে উন্নত মানের শিক্ষার ব্যবস্থা আছে দেশে৷ এমনকি কর্মক্ষেত্রেও নেই বসের চোখরাঙানি৷ ভাবছেন– আকাশ–কুসুম কল্পনা, এমন আবার হয় নাকি! ফিনল্যান্ডে কিন্তু এমনটাই হয়৷
সরকারের আছে হাজারো জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা
ফিনল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের দরবারে তার জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনাগুলির জন্য সুপরিচিত৷ দেশটিতে আছে গণতন্ত্রের সুগঠিত একটি কাঠামো৷ দুর্নীতি প্রায় নেই বললেই চলে৷ জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা আছে মানুষের৷ কর–ব্যবস্থা ও সম্পদের বন্টন এমনই যাতে দেশের সমস্ত মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া যায়, ব্যবস্থা করা যায় সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষার৷
ব্যস্ত সময়, ব্যস্ততর যুগ, ব্যস্ততম যুব সমাজ... ছুঁটে চলেছে লক্ষ্যহীন, দিকভ্রান্ত হয়ে। আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে। এই "বিষ-ময়" সময়েও যিনি আশ্রয়, পথপ্রদর্শক, তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর বাণী, তাঁর আদর্শই হোক আমাদের যুব সমাজের ঐক্য সঙ্গীত।
কাজের ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড একটি চমৎকার মডেল তৈরি করেছে৷ সেখানে সংস্থার কর্তৃপক্ষ আর কর্মচারীদের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান নেই৷ বরং কর্মচারীরা নিজেরাই জড়িয়ে থাকেন সংস্থার ভালোমন্দের সাথে৷ ফলে একদিকে যেমন উৎপাদন বিপুল বাড়ে, তেমনই কাজ করে কর্মীরা বসের চোখরাঙানির বদলে পান অসীম পরিতৃপ্তি৷
ফিনল্যান্ডে নারী–পুরুষের মধ্যে কোনও বেতন–বৈষম্য নেই৷ শুধু তাই নয়, বিশ্বের মধ্যে এই একটিমাত্র দেশেই বোধহয়, স্কুল–পড়ুয়া সন্তানদের সঙ্গে মায়েদের তুলনায় বেশি করে সময় কাটান বাবারা৷ এই ঘটনা নিঃসন্দেহে ফিনল্যান্ডের প্রগতিশীল চরিত্রটিকে তুলে ধরে৷ বাস্তবে গোটা সমাজ জুড়েই মানুষে মানুষে বৈষম্যের বড় অভাব এই দেশটিতে৷ দেশের দরিদ্রতম মানুষটিও যাতে কোনও দিক থেকে কোনও ভাবে বঞ্চিত না হন, সে ব্যাপারে ফিনল্যান্ডের সরকার সদা সতর্ক৷
কিন্তু শুধুই কি সরকার, নাকি আছে অন্য কোনও রহস্য?
সরকারের ভূমিকা তো আছেই৷ কিন্তু সুখী দেশ হিসাবে নিজেদের খুশি ধরে রাখার পিছনে কাজ করে চলেছে ফিনল্যান্ডের মানুষের অনুপম এক চরিত্রবৈশিষ্ট্য, যা তাঁদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ ফিনিশীয়দের আছে এক অদম্য সত্তা যা যে কোনও বাধা–বিপত্তি, প্রতিকূলতা মোকাবিলায় তৈরি৷ ফিনিশীয় ভাষায় এই সত্তা পরিচিত ‘সিসু’(sisu) নামে৷ ‘সিসু’বলে বলীয়ান ফিনল্যান্ডের মানুষ সমস্যার সামনে ভেঙে পড়েন না, কোমর বেঁধে লেগে যান তার মোকাবিলা করতে৷ হৃদয়ের এই শক্তির জোরেই তাঁরা গড়ে তুলেছেন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশটিকে৷
ভোগের মধ্যে নয়, জ্ঞানের গভীরে গিয়ে আনন্দ খোঁজা
আধুনিক ভোগসর্বস্ব পৃথিবীর বাসিন্দা হয়েও ফিনল্যান্ডের মানুষ অনবরত জিনিসপত্র কেনাকাটায় বিশ্বাসী নন৷ তাঁদের প্রয়োজন সীমিত৷ বরং তাঁরা বেশি ভালবাসেন বইপত্র পড়তে, জ্ঞানজগতে বিচরণ করতে৷ ৫৫ লক্ষ মানুষের এই দেশে আছে অগুনতি লাইব্রেরি৷ সারা বছরে সেখানে প্রায় ৭ কোটি বইয়ের আদানপ্রদান হয়৷ লোকদেখানো জাঁকজমকের জৌলুষও পছন্দ নয় তাঁদের৷ ‘সিসু’ সংসৃক্তি তাঁদের শিখিয়েছে নম্র হতে, বিনয়ী হতে৷ তাই সমাজমাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে নিজের রঙ–করা ছবি মেলে ধরার বদলে ফিনল্যান্ডের মানুষ তৃপ্তি খুঁজতে ডুব দেন মনের গহীনে৷
"ভালো মন্দ যাহাই আসুক/সত্যেরে লও সহজে"
‘সিসু’ সংসৃক্তির অধিকারী ফিনল্যান্ডের মানুষের কাছে অঢেল অর্থ উপার্জনই জীবনের ধ্রুবতারা নয়৷ নিজেদের জন্য ভীষণ উঁচু কোনও টার্গেটও স্থির করে রাখেন না তাঁরা৷ জীবন যেভাবে সামনে আসে, সে ভাবেই তাকে গ্রহণ করার পক্ষপাতী এই মানুষগুলি৷ এটাই তাঁদের সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র৷ সুখের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানো নয়, সমস্যার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়াও নয়, জীবনকে, জীবনের সত্যকে সহজ ভাবে নিতে শিখেছেন ফিনিশীয়রা৷
মনেরে তাই কহ যে
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে
– কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘বোঝাপড়া’ কবিতার এই পংক্তিগুলি ফিনল্যান্ডের মানুষই বোধহয় সত্যিকারের অর্থে গ্রহণ করেছেন নিজেদের জীবনে এবং খুঁজে পেয়েছেন সুখে থাকার সেই গোপন চাবিকাঠিটি৷