অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেন না আজকের স্পষ্টবাদী অরিত্র, ভয় নেই "ইমেজ" নষ্ট হওয়ার

নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশিত: 11/07/2023   শেষ আপডেট: 11/07/2023 11:52 a.m.
instagram.com/arithrough

পরিদর্শকের সঙ্গে খোলামেলা আড্ডায় অরিত্র দত্ত বণিক

অরিত্র, নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক দুষ্টু মিষ্টি প্রানবন্ত শিশুর মুখ, এবং ততই দুষ্টু মিষ্টি তাঁর কার্য কলাপ। পর্দায় মূলত তাঁর উপস্থিতি থাকত "কমিক রিলিফ" হিসেবে। সেই অরিত্রই আজ হয়ে উঠেছেন সমাজের চোখে এক স্পষ্টবাদী ব্যক্তিত্ব। সাম্প্রতিক যেকোনও রকম বিষয় নিয়েই তিনি তাঁর মত প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। পেশা হিসেবে রয়েছে তাঁর হাতে একাধিক কাজের বৈচিত্র্য। ক্যামেরার সামনে অভিনয় তো বটেই, সঙ্গে রয়েছে ক্যামেরার পিছনে ছবি সংক্রান্ত নানা পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ। সব মিলিয়ে ভালই আছেন, "পরাণ যায় জ্বলিয়া রে"র দেবের (Dev Adhikari) একরত্তি ক্ষুদে সঙ্গী অরিত্র দত্ত বণিক (Aritra Dutta Banik)।

এত্ত ছোট বয়সে কীভাবে অরিত্র হয়ে উঠেছিলেন দর্শকের মুখের হাসির কারণ? কীভাবেই বা তাঁর সাবলীল সঞ্চালনায় মুগ্ধ করতেন দর্শককে? পরিদর্শককে তিনি জানান, ছোট থেকেই তিনি ছিলেন মিশুকে। নিজের 'প্লাস পয়েন্ট' হিসেবে এই প্রবণতার প্রতিই তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। যদিও মিশুকে হওয়ার সঙ্গে তিনি ছিলেন যথেষ্ট পরিমাণে দুরন্ত, তাই তাঁর নিজস্ব স্বভাব অনুযায়ীই পর্দায় তাঁকে তাঁর মত করেই চরিত্র নির্মাণ করতেন পরিচালকসমূহ। রাজ্যস্তরে আবৃত্তি করতে গিয়ে, প্রখ্যাত পরিচালক যীশু দাশগুপ্তের (Jishu Dasgupta) নজরে আসেন ক্ষুদে অরিত্র। সুযোগ পান 'তিথির অতিথি' (Tithir Atithi) ধারাবাহিকে। তথাকথিত অভিনয়ের প্রশিক্ষণ না থাকলেও, অরিত্র যে সকল গণ্যমান্য অভিনেতা অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁরাই হয়ে উঠেছেন তাঁর চলার পথের পাথেয়। সেই কারণেই ক্যামেরার সামনে ছোট বয়স থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন দক্ষ শিল্পী। কিন্তু বাঙালী পরিবারে যেখানে সর্বপ্রথম মূলত পড়াশুনার প্রতি জোর দেওয়া হয়, সেখানে অরিত্রকে এই রুপোলি ক্যানভাসে প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়ার পেছনে, পরিবারের সমর্থনকেও একেবারেই কম গুরুত্ব দেওয়া যায় না। সেই অর্থে তাঁর পরিবারের কেউই রুপোলি দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু অরিত্রর এগিয়ে যাওয়ার পথে যাতে কোনও বাধা না আসে, সেদিকে সকলের দৃষ্টি ছিল। মা, বাবা, এমনকী তাঁদের কর্মক্ষেত্র এবং অবশ্যই অরিত্রর স্কুলের অবদানের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে তাঁর সাফল্যের পেছনে।

অরিত্র মনে করেন, সামাজিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে যেকোনও ব্যক্তির যেন পায়ের তলার মাটি শক্ত থাকে। ছোট থেকেই তিনি জীবনের নানা উত্থান পতনের সাক্ষী। তাই ঠিক করে রেখেছিলেন অভিনয়ের সঙ্গে পড়াশুনাকেও আলাদা ভাবে প্রাধান্য দেবেন, যাতে ভবিষ্যতে অভিনয়ের সুযোগ না পেলেও, বিকল্প কাজের সুযোগ পান। পরিদর্শক যখন দর্শকের কাছে আজকের প্রাপ্তমনস্ক অরিত্রর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে, অরিত্র জানান এর ভালো মন্দ দুটি দিকই রয়েছে। মন্দ হিসেবে তিনি জানান, এখনও মানুষ তাঁকে "পরাণ যায় জ্বলিয়া রে"র 'বিচ্চু বাচ্চা' হিসেবেই বিচার করেন। তাঁর মুখে স্পষ্ট কথা শোনা যেন মানুষের কাছে 'হাস্যস্পদ'! এছাড়াও মানুষের একটি ধারণা, চুল দাড়ি না পাকলে রাজনৈতিক বিষয়ের প্রতি মত প্রতিষ্ঠা করা যায় না! সেখানেই অবাক হন অরিত্র। তিনি মনে করেন, সামাজিক মাধ্যম নিজস্ব বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্র, সেখানে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কিছু অনুভব ব্যক্ত করতেই পারেন। কিন্তু মানুষ সেটিকেই 'ব্রহ্ম সত্য' ধরে বসে আক্রমণ শুরু করেন। আবার কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অরিত্রর বক্তব্য বুঝে, নিজেদের চিন্তনও প্রকাশ করেন। রাজনৈতিক মত প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁকে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। তিনি সকল গোষ্ঠীরই ভালো খারাপ দিক তুলে ধরেন, তবুও তাঁকে ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হতে হয়।

অরিত্রর স্পষ্টবাদী মত প্রকাশের জন্য কখনও কি তাঁর ছোটবেলার জনপ্রিয়তার "ইমেজ" নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় হয়? পরিদর্শককে অরিত্র পরিষ্কার জানান, "আমরা যে প্রক্রিয়ার অধীন তার বিরুদ্ধে কথা বললেই সমাজের চোখে আমাদের নিচে নেমে যেতে হয়। তাই বড় বড় ব্যক্তিত্বরা একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে গেলেও নীরব থাকেন। সকলেই 'লুক গুড, ফিল গুড' মনোভাব নিয়ে চলেন।" বলা বাহুল্য, তিনি মোটেই এই দলের অন্তর্ভুক্ত নন। কোনওদিন কোনওরকম জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে কার্যসিদ্ধি করেননি। দিনের শেষে তিনি বিশ্বাস করেন, সৎ পথে চলে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই এগিয়ে যেতে হয়।

অরিত্র অভিনয়ের জন্য পাড়ি দিয়েছেন মহানগরী মুম্বইয়েও। সেখানেও বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন সংস্কৃতির অভিনেতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করে তিনি যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। যদিও ছোটবেলার "ইমেজ"কে পেরিয়ে গুরু গম্ভীর চরিত্রে প্রথমে তাঁকে গ্রহণ করতে দর্শকদের সমস্যা হয়েছিল বৈকি! তবে পরবর্তীতে সঠিকভাবে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি বড় পর্দায় তাঁর অভিনীত চরিত্র দিয়ে দর্শকদের মনে দাগ কাটেন। বাংলাতেই বাংলা ছবির কদর কমে যাচ্ছে কিনা এই প্রসঙ্গে তাঁকে পরিদর্শকের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, "একজন পরিচালককে সবার আগে বুঝতে হবে সিনেমার প্রতি দর্শকের চাহিদা কেমন! গ্রাম দিয়ে শহরের মানুষের চাহিদা, অথবা শহর দিয়ে গ্রামের মানুষের চাহিদা বোঝা সম্ভব নয়। কারণ আজকালকার বেশিরভাগ ছবি, কখনও এই দু'স্থানের মানুষকেই 'টার্গেট অডিয়েন্স' করতে সক্ষম নয়। সকলের কী চাহিদা, সেই বিষয়ে পরিচালকে ওয়াকিবহাল হতে হবে"। যদিও পরিচালক হওয়ার ইচ্ছে এই মুহূর্তে তাঁর নেই, তবে একজন ভালো প্রযোজক হয়ে উঠতে তিনি বেশ আগ্রহী। কিন্তু অভিনয় জগতে থাকাকালীন তিনি রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠতে কখনওই উৎসাহী নন। প্রথমত রাজনীতি একটি সারাদিন-ব্যাপী পেশা, এছাড়াও যখনই তিনি কোনও বিশেষ দলের নেতা হয়ে উঠবেন তখন তাঁর ছবি তাঁর বিরোধী দলের দর্শক দেখতে সংকোচ বোধ করবেন। তাই এই সমস্যার মুখোমুখি অভিনেতা হিসেবে যে তিনি একেবারেই হতে চান না, তা পরিদর্শককে জানান অরিত্র।

পরিশেষে অরিত্র পরিদর্শকের পাঠক তথা তাঁর অনুগামীদের উদ্দেশ্যে বলেন, "জীবনে চড়াই উৎরাই আসবেই। এমনকী সৎ সাহস রেখে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও সঞ্চয় করতে হবে। তবেই দিন শেষে তুমি নিজের কাছে পরিষ্কার থাকবে, এবং মনে সবসময় ইতিবাচকতার মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে"। এছাড়া তিনি তাঁর অনুগামীদের থেকে যে পরিমাণ স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছেন তার প্রতি তিনি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন।