পরিবেশের পরিবর্তনের জন্য বন্যার সম্ভাবনা বাড়বে গঙ্গায়, নতুন রিপোর্টে চাঞ্চল্য

নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশিত: 18/11/2021   শেষ আপডেট: 18/11/2021 10:50 p.m.
বন্যা www.pixabay.com

আইআইটি কানপুর এবং আইআইএসসি ব্যাঙ্গালোরের এই নতুন রিপোর্টে জানানো হয়েছে, নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বন্যার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলে

আইআইএসসি বেঙ্গালুরু এবং আইআইটি কানপুরের একটি নতুন গবেষণা পত্রে রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে ভারতে। সম্প্রতি এই নতুন রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে গঙ্গায় নতুন করে প্লাবনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মানুষের কার্যকলাপ ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য গঙ্গায় আরো বেশি করে বন্যার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই বন্যার সম্ভাবনার মূল কারণটা হলো অতিরিক্ত জলপ্রবাহ। নদীতে ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত মানব কার্যকলাপের জন্য নদীর জল স্তর বাড়তে শুরু করেছে। ভারতের প্রত্যেকটি নদীর নাব্যতা ধীরে ধীরে কমছে। জল দূষণ এবং নদী বাঁধ ভাঙ্গনের ফলে প্রত্যেকটি নদীতে পলি জমার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ধীরে ধীরে। সাইন্টিফিক রিপোর্টস নামের একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে বলে খবর।

নতুন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, নদীতে অত্যধিক বাঁধ তৈরি, আবহাওয়ার মাত্রাতিরিক্ত পরিবর্তন এবং আরো একাধিক কারণের জন্য নদীতে প্লাবনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চলে ধীরে ধীরে মানুষের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই পাহাড়ি অঞ্চলে ভ্রমণ করতে যাচ্ছেন এবং সেখানকার পরিবেশ দূষিত করে আসছেন। যার ফলপ্রসূ বৃদ্ধি পাচ্ছে পরিবেশ দূষণ এবং নদী দূষণ। ভাগীরথী এবং অলকানন্দা নদীতে মূলত এই গবেষণা করা হয়েছিল। দেবপ্রয়াগের সামনে থেকে এই দুটি নদী একসাথে মিশে গিয়ে গঙ্গাকে তৈরি করে। পশ্চিম দিকের অংশটি অর্থাৎ ভাগীরথীর উৎপত্তি হয় গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে। অন্যদিকে পূর্বের অংশটি অর্থাৎ অলকানন্দার উৎপত্তি হয় সতপন্থ হিমবাহ থেকে। দেবপ্রয়াগ এর সামনে এই দুটি নদী একসাথে মিশে গিয়ে আসল গঙ্গাকে তৈরি করে। উত্তর গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলে ঋষিকেশ পর্যন্ত গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, নদী দূষণের কারণে গঙ্গার আশে পাশের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হবার সম্ভাবনা বাড়ছে।

২০১০ সালের আগে ভাগীরথীতে ৪ টি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে অলকানন্দা নদীতে আরো দুটি নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ এর মধ্যে মাত্রাতিরিক্তভাবে অলকানন্দা নদীর জলপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার পরের কয়েক বছরেও নিয়মিতভাবে নদীর জলপ্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলপ্রসূ গঙ্গা অববাহিকার একাধিক জায়গায় জলপ্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। আইএএসির একজন বিজ্ঞানী সোমিল স্বর্ণকর জানাচ্ছেন, "অলকানন্দা অববাহিকায় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বৃষ্টি হয় এবং সেই অঞ্চলে অনেক বেশি জলপ্রবাহ। অলকানন্দা নদীর নিম্ন প্রবাহ সাধারণত এই জলপ্রবাহের পরিমাণ সবথেকে বেশি থাকে। যেহেতু এমনিতেই অলকানন্দা নদীর জল প্রবাহের পরিমাণ বেশি তাই অলকানন্দা অববাহিকায় বন্যার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি দেখা যাচ্ছে।"

তার সাথে সাথেই বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, অলকানন্দা অববাহিকায় এই যে দুটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, তার জন্য জলপ্রবাহের পরিমাণ আরো বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীর স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি রুদ্ধ করে দিয়ে মানুষের কার্যকলাপের জন্য নদীর জলকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে নদীর স্বাভাবিক জলপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং নদীর নাব্যতা কমছে। গঙ্গার নিম্ন প্রবাহ পলীর পরিমাণ আরো কমতে শুরু করেছে, যার ফলে নদীর বদ্বীপ এর রূপ কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। তবে পরিবেশ দূষণের জন্য সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারতের হিমালয় অঞ্চল। এছাড়াও স্বাদু জলের নদীতে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বাঁধ দেওয়ার ফলে নদী গুলির স্বাভাবিক প্রবাহ আস্তে আস্তে ব্যাহত হতে শুরু করেছে। হিমালয় অঞ্চলে ইকোলজিক্যাল সিস্টেমের সমস্যার কারণে মোদিকে জলের পরিমাণ বাড়ছে। উত্তর গঙ্গা অববাহিকায় তেহারি বাঁধ এই জলের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সবথেকে বেশি দায়ী। এই বাঁধটি সাধারণত গঙ্গা নদীর উচ্চ প্রবাহের বেশ কিছু জায়গায় পলি জমাট করতে শুরু করছে। এর ফলে উত্তর প্রবাহী যেখানে জলের গতি সবথেকে বেশি থাকার কথা সেখানে আস্তে আস্তে পলির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নদীর নাব্যতা কমতে শুরু করেছে।

তবে এই সমস্যার কিছু সমাধানের কথাও উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের কথায়, আধুনিক টেকনোলজি এবং অত্যাধুনিক নতুন ধরনের হাইড্রোলিক পাম্প যদি স্থাপন করা যায় তাহলে নদীর জলপ্রবাহের এই যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা আটকানো সম্ভব হবে। আই.সি.ডাবলিউ.এ.আর এর অধ্যাপক প্রদীপ মজুমদার বলেছেন, "পরিবেশে কি পরিবর্তন হবে সেটা নিয়ে আমরা তেমন কিছু করতে পারিনা। সত্যি কথা বলতে গেলে পরিবেশের উপর আমাদের তেমন একটা হাত নেই। পরিবেশের পরিবর্তন আটকানোর জন্য আমাদের সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। কিন্তু, স্থলভাগে আমাদের হাতে কিছুটা ক্ষমতা রয়েছে। আমরা যদি ভালোভাবে নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করে সেগুলির মাধ্যমে নতুন কোনো পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে পারি তাহলে সেটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অনেকটা লাভকারী হবে। হাইড্রোলজিক্যাল মডেলের মাধ্যমে আমরা নানা ভাবে নদীর জলপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারি। এই ধরনের অত্যধিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাদের কাছে কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এজন্য সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে এবং ওই বাঁধ নির্মাণকারী সংস্থাগুলিকে। যদি আমরা সবাই একসাথে কাজ না করতে পারি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের একাধিক নদী অববাহিকায় বন্যার সম্ভাবনা বাড়বে, যা আমাদের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভয়ানক একটি বিষয় হতে উঠবে।"