সালটা ১৯৬২। ব্রিটিশদের কঠিন শাসনপাশ থেকে সদ্যমুক্ত দেশের সবেমাত্র পথচলা শুরু। দেশের প্রতিটি কোণায় তখন অন্ধতার প্রতিচ্ছবি, পাশাপাশি কিছু প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে নির্জনতার ছদ্মবেশে কঠিন লড়াই তো আছেই!
হঠাৎই একদল শিক্ষার্থী, শুভানুধ্যায়ী, বন্ধুবান্ধব উপস্থিত তাঁদের প্রিয় শিক্ষকের জন্মদিবস পালনের প্রত্যাশায়। কিন্তু তিনি তো আর চার-পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো নন। ঢক্কা-নিনাদে নিজের গরিমা প্রকাশে তাঁর চূড়ান্ত অনীহা! নিজেই জানালেন তাঁর মনের কথা। "হ্যাঁ, তোমরা যদি আমার জন্মদিনে সম্মান জানাতে চাও, তাহলে এই দিনটি আমার জন্মদিন নয়, এই জাতির এই দেশের মহান কারিগরদের সম্মান জানাতে এই দিনটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন কর।" আর তারপর থেকেই শোনা যায়, প্রতি বছর ৫ সেপ্টেম্বর গোটা দেশজুড়ে সেই মানুষদের সম্মান জানানো হয়, যাঁদের অকৃত্রিম পরিশ্রম, কর্মকান্ড 'এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলো'-র বার্তা জ্বালিয়ে রাখে!
হ্যাঁ, কথা হচ্ছে এ জাতির মহান শিক্ষক ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণকে নিয়ে। স্বাধীন দেশের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি, দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি তিনি। কিন্তু তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি একজন জনপ্রিয় শিক্ষক, 'ফ্রেন্ড ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড'। যাঁর একটি ক্লাস মানেই মুগ্ধতার আর এক নাম, যাঁর একটা ক্লাস 'পিন অফ সাইলেন্স'।নিজেই ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। নিজের অধিকাংশ পড়াশোনাই ছাত্রবৃত্তির সাহায্যে। শোনা যায়, ড. রাধাকৃষ্ণণের সেইসময় জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি ছিল যে কলকাতা যাওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেল স্টেশন পর্যন্ত পুষ্পস্তবকে সাজানো গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁর সুবচনে মুগ্ধ ছিলেন দেশ-বিদেশের বহু মানুষ। নিজের জন্মদিনটি তিনি এ জাতির সেই মানুষদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন, যাঁরা উদয়াস্ত নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন। জাতির উদ্দেশ্যে বড় দান আর কীই-বা থাকতে পারে!
প্রতি বছর গোটা দেশে ৫ সেপ্টেম্বর সাড়ম্বরে 'শিক্ষক দিবস' পালিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এ জাতির মহান শিক্ষক ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের জন্মতিথি। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ৫ অক্টোবর তারিখটিকে 'শিক্ষক দিবস' হিসেবে পালন করেন। ইউনিসেফের পক্ষ থেকে ৫ অক্টোবর তারিখটি 'বিশ্ব শিক্ষক দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই একটা দিন বিশ্বের অগণিত শিক্ষকদের মহান আদর্শ ও বিপুল কর্মকান্ডের প্রতি সম্মান জানানোর দিন।
একটি সদ্যোজাত যখন মায়ের কোলে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রথম চোখ মেলে ধরে, তখন থেকেই তার শেখার শুরু। এই প্রকৃতির হাত ধরেই তার হাতেখড়ি। প্রকৃতির আলো-বাতাস-গন্ধে সেই যে তার শেখার শুরু, চলতে থাকে আমরণ! আর শিক্ষা কি কেবল নেওয়ার? দেওয়ারও বটে! কথায় আছে, "দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে..." একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষক কে? এ প্রশ্নের একটাই উত্তর 'মা'। মা-ই মানুষের প্রথম গুরু।
সংস্কৃততে একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে, 'বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্' অর্থাৎ বিদ্যা বা শিক্ষা মানুষকে বিনয় দান করে। এই বিনয় একজন মানুষকে 'খাঁটি মানুষ' হিসেবেই গড়ে তোলে। আজকাল হয়তো-বা কথায় কথায় বলে থাকি, সেই আগের গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক আর নেই! হ্যাঁ, কথাটি ভুল নয়। শিক্ষক যদি শিক্ষাকে ব্যবসার পর্যায়ে নামিয়ে আনেন, সেখানে বেসাতি বই আর কীই-বা হতে পারে! বদলেছে শিক্ষার ধরণ, পরিবেশ তো বদলাবেই। তারপরও এই একটা দিন মানুষ শ্রদ্ধা জানায় তাঁর জীবনের ছায়াপথে আলোক-বর্তিকা জ্বালিয়ে রাখা মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে। তা তিনি কোন শিক্ষক, কিংবা কোন বন্ধু, হয়তো-বা প্রিয়জন। এই প্রসঙ্গে জাপানের একটি প্রবাদ বাক্যের কথা বলা যায়, "Better than a thousand days of diligent study is one day with a great teacher". এই হোক ধ্রুবসত্য, এই হোক অঙ্গীকার!