"চাঁদের হাট"―বাংলার এই প্রবাদটির সঙ্গে আমরা সুপরিচিত। একই সময়ে একই অবস্থানে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের সমাবেশকে আমরা এই ভাবে চিহ্নিত করি। কিন্তু একটা যুগের কথা যদি বলি, যখন কালপুরুষের প্রতিটা নক্ষত্র যেন আমাদের জাতি, আমাদের সত্তা তথা আমাদের দেশের রক্ষক, ধারক ও বাহক ছিলেন। শুধু, ছিলেন বলা ভুল। কারণ, নক্ষত্রের তো বিনাশ হয় না। তাদের কাজ আলো ছড়ানো, উদ্ভাসিত করা। আমাদের জাতির, দেশের তথা সমগ্র বিশ্বের দুই অন্যতম অগ্রণী মহামানব সেই কাজটি আজও সুচারুভাবে পালন করছেন। একজন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্যজন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। দু'জনের কর্মপরিধি, আদর্শ, বাণীকে সম্বল করেই আমাদের পথচলা। কিন্তু তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন ছিল, সেই বিষয়েই আজকের বিশেষ প্রতিবেদন আমাদের।
একবার টাইম মেশিনে চড়ে ভারতের স্বাধীনতার বছর থেকে পিছিয়ে যাই ১৪ বছর আগে। সালটা ১৯৩৩; সুভাষ তখন অসুস্থ। ইউরোপে এসে চিকিৎসকদের পরামর্শে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন। কিন্তু, সুস্থ হবার একমাত্র শর্ত 'বিশ্রাম'। কর্মঠ মানুষের পক্ষে যা সত্যি কষ্টকর। তাঁর দিন যেন কাটতেই চাইছে না। সেই সময় তিনি আশ্রয় নিলেন লেখালিখির জগতে। লন্ডনের প্রকাশনা সংস্থা "Wishart & Company" এর প্রকাশক খবর পেলেন, সুভাষ কিছু একটা লিখছেন। তিনি খবর পেয়েই এলেন তাঁর কাছে, অগ্রিম টাকা দিয়ে গেলেন, সুভাষের লেখা সম্পন্ন হলে তিনি প্রকাশ করবেন। এবার সুভাষ পেলেন নতুন প্রেরণা, উদ্যম। কলম চলল...পাতার পর পাতা নব সৃষ্টির কোলাহলে ভরে উঠতে লাগলো। বই এর নাম স্থির হল, "The Indian Struggle" । বই প্রকাশের উত্তেজনা তখন তুঙ্গে। বইটি যে সারা পৃথিবীতে সারা ফেলবে, সেই বিষয়ে নিশ্চিত থাকলেন একপ্রকার তিনি। প্রকাশের আগেই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের কথাও ভাবা হয়ে গেছে। প্রস্তুতি তো তুঙ্গে, কিন্তু, "সূচনা" বা "ভূমিকা" অংশ লেখার কী হবে! এই ব্যাপারে সুভাষ, কবিগুরুর শরণাপন্ন হলেন। এক বিশাল চিঠি প্রেরণ করলেন তিনি রবি ঠাকুরের কাছে। পনেরো দিন পর এল উত্তর। সুভাষের চিঠির যে আয়তন ছিল, তার চেয়ে অনেক ছোট ও সংক্ষিপ্ত চিঠি তিনি পাঠিয়েছেন। চিঠি খোলার মুহূর্তে সুভাষের যে উত্তেজনা কাজ করছিল, সংক্ষিপ্ত চিঠি পাঠ করার পর তাঁর সেই আনন্দ-উত্তেজনা-উৎসাহ একেবারে ম্লান হয়ে গেল। সেই চিঠি নিয়ে আনমনা হয়ে বসে রইলেন সুভাষ। তিনি রবি ঠাকুরকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর বই এর 'সূচনা' অংশ লেখার জন্য ঠাকুর যেন H G Wells এবং Bernard Shaw কে অনুরোধ করেন। কিন্তু রবি ঠাকুর সরাসরি সেই 'সংক্ষিপ্ত' চিঠিতে সেই অনুরোধ রাখতে না পারার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। লিখেছেন,
"Bernard Shaw কে আমি ভালোমতই জানি। তোমার বইয়ের পূর্বভাষণ লেখবার জন্য তাকে অনুরোধ করতে আমি সাহস করিনে। করলেও ফল হবে না, এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তোমার পাণ্ডুলিপিখানির এক কপি তুমি নিজেই তার কাছে পাঠিয়ে দেখতে পারো। এতদিনে সংবাদপত্র যোগে নিশ্চয়ই তিনি তোমার পরিচয় পেয়েছেন।"
অভিমানী সুভাষ এবার ভাবলেন, নিজের বইয়ের সূচনা তিনি নিজেই লিখবেন। স্বপ্ন বুনছেন নিজের লেখা বইকে ঘিরে। ঠিক সেই সময় এক দুঃসংবাদ... তাঁর পিতা জানকীনাথ বসু অসুস্থ। সুভাষ তৎক্ষণাৎ প্লেনে চড়ে ভারতে এলেন। বিমান বন্দরে পা রাখতেই খবর পেলেন, তাঁর বাবা চিরনিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছেন। পিতৃশোক কাটেনি তখনও.. খবর এল, ইউরোপে পুলিশ তাঁর বাড়ি, জিনিসপত্র তল্লাশি করে তাঁর লেখা সেই স্বপ্নের বই "The Indian Struggle" এর টাইপ করা কপি বাজেয়াপ্ত করেছে। করাচি থেকে কলকাতা ফিরেছেন সুভাষ। খবর পাচ্ছেন, দিকে দিকে উঠেছে প্রতিবাদ, তাঁর বিরুদ্ধে ব্রিটিশের কঠোর দমননীতির। আর প্রতিবাদে অন্যতম অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, H G wells, Bernard Shaw।
যাঁদের দিয়ে নিজের বইয়ের সূচনা অংশ লেখাতে চেয়েছিলেন, তাঁরাই আজ তাঁর পাশে, তবু আজ সুভাষ আর চান না তাঁদের দিয়ে লেখাতে। লিখেবন তিনি স্বয়ং... শর্তাধীনে তখন তিনি গৃহবন্দি এলগিন রোডের বাড়িতে। সঙ্গী কাগজ আর কলম। উন্মুক্ত কণ্ঠে গাইছেন, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে...", আর সেই গানের প্রচন্ড তেজে লিখে চলেছেন সুভাষ...নেতাজি।
সেই ১৯৩৩ সাল। "একটি আষাঢ়ে গল্প" নামক ছোটগল্পের কাহিনি অবলম্বনে রবি ঠাকুর লিখলেন, "তাসের দেশ।" উৎসর্গ করলেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে। উৎসর্গ পত্রে লিখলেন,
" কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র, স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক'রে তোমার নামে "তাসের দেশ" নাটিকা উৎসর্গ করলুম। শান্তিনিকেতন, মাঘ, ১৩৪৫ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর"।
রবি ঠাকুর বিশ্বাস করতেন এবং অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতেন, এই পীড়িত ও শোষিত দেশে একজন প্রকৃত দেশনায়কের প্রয়োজন। আর তিনি তাঁর সুভাষচন্দ্রের মধ্যে সেই সমস্ত গুণাবলী দেখতে পেয়েছিলেন। তাই বলেছিলেন, "সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি, বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি....স্বজাতিকে বিশ্বের দৃষ্টি-সম্মুখে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে মান বাঁচাতে হবে।" বলাই বাহুল্য, আমাদের নেতাজি, আমাদের দেশনায়ক সারাটা জীবন দিয়ে সেই কাজটিই করে গেছেন। দেশমাতৃকাই তাঁর একমাত্র অস্তিত্ব, তাঁর চেতনা, তাঁর আবেগ, তাঁর ভালোবাসা।