আচ্ছা, বাঁটুলের বয়স কত? হাঁদা-ভোঁদার 'ঠান্ডালড়াই' থামবে কবে? কিংবা নন্টে-ফন্টে কি কখনও হস্টেল ছাড়বে না? হস্টেল সুপারিনটেনডেন্ড পাতিরাম হাতি নাকি হাতিরাম পাতির পেছনে লাগা ছাড়বে না নন্টে-ফন্টে?
না, এমন প্রশ্ন কখনও মনে উদয় হয়নি। কখনও মনে হয়নি বাঁটুল বড় হোক কিংবা হাঁদা-ভোঁদার 'ফাইট' থেমে যাক। মনে হয়নি নন্টে-ফন্টে দুষ্টুমি থামিয়ে সুবোধ বালক হয়ে যাক! আসলে, বাঙালি অন্তরাত্মায় লালিত এই চরিত্রগুলোর বয়স বাড়ে না, এদের দুষ্টুমিতে ক্লান্ত হয় না বাঙালি-প্রাণ। বাঙালির আটপৌরে, ঘরোয়া, দ্বন্দ্বহীন জীবনে চরিত্রগুলো যেন বিশল্যকরণী। আমাদের না পাওয়ার বেদনা, সুপ্ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বাসনা কিংবা দুষ্ট-চপল হয়েও অন্যায়-বিরোধী প্রতিমূর্তি তো চরিত্রগুলি। তাই, এত বছর পরও কখনও মনে হয়নি বাঁটুল হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট পরুক। কিংবা নন্টে-ফন্টে হস্টেল ছেড়ে চাকরি করুক!
শৈশব-কৈশোরে ইতিহাস কিংবা বাংলা বইয়ের পাতার আড়ালে 'বাঁটুল দি গ্রেট' পড়েনি, এমন বাঙালির দেখা মেলা ভার। তাদের হাতে মোবাইল ছিল না, ছিল না ট্যাব। ছিল না অনলাইন গেমের নেশা! তবে নেশা তো ছিলই - বাঁটুলের অলৌকিক প্রতিভার সম্মোহন শক্তি। বাঁটুলের বুকে গুলি লেগে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া কিংবা ল্যাম্পপোস্ট উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া অথবা বোমা নিয়ে লোফালুফি - কখনও অবাস্তব মনে হয়নি। যুক্তির কর্কশ স্লোগান তুলে কখনও কেউ বলেনি অবিশ্বাস্য কিংবা বেমানান!
বাঁটুলের দুই স্যাঙাত বিচ্ছু ও বাচ্ছু তো ওই পাড়ার কোন ডানপিটে ছেলের অনুগত সাগরেদ। আজ তো সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যানদের জমানা কিন্তু বাঁটুল দি গ্রেট বাঙালির আটপৌরে জীবনের সঙ্গী। যে দৃশ্যগুলো রোজ দেখে রাগ হয় কিংবা প্রতিবাদে সরব হতে মন চায় - তাই তো কল্পনায় করে বসে বাঁটুল। আর বাঁটুলের মতো কত বাঙালি-প্রাণ পরোক্ষে প্রতীকী প্রতিবাদে সামিল হয়, তার ইয়ত্তা নেই।
বাঁটুল প্রিয় না হাঁদা-ভোঁদা? তাদের স্রষ্টা একবার বলেছিলেন মানুষের কাছে বাঁটুল-ই বেশি প্রিয়। হাঁদা-ভোঁদা তো বাঙালির টম অ্যান্ড জেরি। দু'জনের লড়াইয়ের ফলাফল যেন পূর্বঘোষিত। হাঁদার পরাজয়, ভোঁদার জিত। তবে হাঁদার প্রতি যেন একটু বেশি মায়া, একটু বেশি ভালোলাগা। ওই রোগা-পাতলা ছেলেটির প্রতি যেন একটু বেশি আনুগত্য, একটু বেশি দরদ!
আর স্কুলের হস্টেল জীবনের সঙ্গে তো নন্টে-ফন্টের অগাধ যোগ। দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধুর ছোট্ট একচিলতে ঘরে বন্দী হস্টেল জীবন। অন্যায় থাকলেও ঔদ্ধত্য নেই। অচলায়তনের বেড়াজাল ভাঙার প্রথম মুক্তির আশ্বাস আছে, তবে সেই রুদ্ধদ্বার ভাঙায় লাম্পট্য নেই কিংবা শ্রদ্ধাহীন স্পর্ধাও। আছে কেবল শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা, আছে অন্যায়ের প্রথম পদক্ষেপ, তা-ও তা অভিযানমুখী।
নন্টে-ফন্টে তো বাঙালি পড়ুয়াদের হস্টেল জীবনের পথপ্রদর্শক। দুষ্টু ছাত্র কেল্টুরামের মুখোশ খুলে দেওয়ার কারিগর। চাপল্য আছে, তবে তা ঔদ্ধত্য নয়। হস্টেল সুপারিনটেনডেন্টের প্রতি জ্বালাতন আছে, তবে তা শ্রদ্ধাশূন্য নয়। চরিত্রগুলো শেষে গিয়ে এক ধরণের মূল্যবোধের জন্ম দেয়। বাঙালির সত্তায় লুকিয়ে থাকা এক অবচেতন বোধের স্ফূরণ ঘটায়।
চরিত্রগুলোর স্রষ্টা চলে গেলেন ৯৬ বছর বয়সে। আর চরিত্রগুলোর বয়স কারো পঞ্চাশ, কারো ষাট কিংবা আরও বেশি। কিন্তু আজও তারা হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরল না কিংবা তাদের হস্টেল ছাড়ার সময় হল না! সবাই চলে তো যায়, কিন্তু তাঁদের উত্তরাধিকার বহন করবে তো বাঙালি? আগামী প্রজন্ম নন্টে-ফন্টের প্রেমে মজবে তো কিন্তু বাঁটুলের দুঃসাহসিক অভিযানে সামিল হবে তো? প্রশ্ন থাকল, সময় তার উত্তর দেবে!