করোনা অতিমারির বাধা কাটিয়ে প্রথমবার অনলাইন পরীক্ষার ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ বাঁকুড়ার

শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশিত: 01/07/2021   শেষ আপডেট: 06/07/2021 10:35 p.m.
নিজস্ব চিত্র

সঙ্গে সহযোগী 'পরিদর্শক'

করোনা অতিমারির তাণ্ডব রুখতে বিপুল বিধিনিষেধের চাপে রাজ্যে স্কুল-শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যথেষ্ট অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। স্কুল-কলেজগুলি বন্ধ, বন্ধ রয়েছে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ায়। এই পরিস্থিতিতে এবার বন্ধ হতে বসেছিল পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের মেধা অন্বেষণ পরীক্ষাটিও। কিন্তু সমস্ত বাধা দূরে ঠেলে ‘পরিদর্শক'-এর হাত ধরে গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য খুশির খবর নিয়ে এল ‘জিটলিন'– পরীক্ষা সংক্রান্ত এক বিশেষ সফটওয়্যার। এর সাহায্যে মেধা অন্বেষণ পরীক্ষায় বসার স্বপ্ন সফল হল কয়েকশো ছাত্রছাত্রীর। প্রযুক্তিগত সহায়তায় ছিল ‘পরিদর্শক'।

বিজ্ঞান-সচেতনতা প্রসারের কাজে নিরলস পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ

সেই ১৯৮৬ সাল থেকে রাজ্যে বিজ্ঞানচেতনা প্রসার ও প্রচারের কাজ করে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ। কুসংস্কার রুখতেও কাজ করে চলেছে এই সংগঠন। এখনো পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলি থেকে মহিলাদেরকে ভুতে ধরার, ডাইনী অপবাদে সমাজচ্যুত করার খবর আসে। খবর পাওয়া মাত্রই বিজ্ঞান মঞ্চ সেখানে হস্তক্ষেপ করে এবং প্রতি ক্ষেত্রেই সফলতা আসে। এখনো ভুতে ধরেছে বলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। এখনো সাপের কামড়ে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে মনসার থানে বা ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রচারও চলে সমান ভাবে। দোষীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সহায়তায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বর্তমানে এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ৩ লক্ষ ৪২ হাজারের মতো। সামাজিক ও আর্থিক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-গ্রামান্তরে ছেলেমেয়েরা যাতে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সেজন্য গত ২৮ বছর ধরে প্রতি বছর পরীক্ষা নিয়ে চলেছে বিজ্ঞান মঞ্চ। পরীক্ষা নেওয়া হয় মূলত অঙ্ক ও সাধারণ বিজ্ঞানের ওপর। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা এতে অংশ নিতে পারে। প্রত্যেক বছরই কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী এই পরীক্ষায় অংশ নেয়। বিজ্ঞান বিষয়টিকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে জনপ্রিয় করতে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের এই উদ্যোগ দেশ জুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের হাত থেকে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে এই সংগঠন।

এতদিন পর্যন্ত এই মেধা অন্বেষণ পরীক্ষা নেওয়া হত প্রচলিত পদ্ধতিতে। গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা মঞ্চের আঞ্চলিক দফতরগুলিতে ফর্ম পাওয়া যেত। পরীক্ষায় বসতে চাইলে ফি-র বিনিময়ে সেই ফর্ম পূরণ করতে হত। এলাকায় এলাকায় তৈরি হত পরীক্ষাকেন্দ্র। নির্দিষ্ট তারিখে সেখানে গিয়ে পরীক্ষা দিত ছেলেমেয়েরা। কয়েক সপ্তাহ পরে মঞ্চের আঞ্চলিক দফতরগুলি থেকেই সংগ্রহ করা যেত রেজাল্ট-কার্ড। পরে মঞ্চের উদ্যোগে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ভালো রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া হত পুরস্কার।

সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এল 'নাইনটিন্থ ক্রস'

কিন্তু বর্তমান করোনা অতিমারির এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে সরকারি নানা বিধিনিষেধের চাপে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধায় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ বাঁকুড়ার কর্মকর্তারা। বহু বছরের রীতি অমান্য করে শেষপর্যন্ত তাঁরা ২০২০ সালের মেধা অন্বেষণ পরীক্ষা বন্ধ রাখারই সিদ্ধান্ত নেন। খবরটি পৌঁছায় ‘নাইনটিন্থ ক্রস' নামে একটি সফটওয়্যার প্রোগ্রাম নির্মাতা সংস্থার কাছে। এগিয়ে আসেন তারা। এই সংস্থাটি ইতিমধ্যেই তৈরি করেছে 'জিটলিন' নামের একটি পরীক্ষা নেওয়ার সফটওয়্যার, যেটি থ্রি-জি ইন্টারনেট ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও কাজ করতে পারে। মঞ্চের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হয়। গ্রামবাংলায় জিটলিন ব্যবহার করে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া আদৌ সম্ভব হবে কিনা, সে বিষয়ে প্রথম দিকে সংগঠনটির একটি অংশের মানুষ যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। পরে বেশ কয়েকটি বৈঠকের পর পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের বাঁকুড়া জেলা শাখা সিদ্ধান্ত নেয় জিটলিনের সাহায্য নিয়েই নেওয়া হবে মেধা অন্বেষণ পরীক্ষা-২০২০।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় 'জিটলিন'

কাজ শুরু হল পুরোদমে। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলিতে ইন্টারনেট সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট অজ্ঞতা রয়েছে। যে অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলি মানুষজন ব্যবহার করেন, সেগুলির মান বিশেষ উন্নত নয়। ফলে সফটওয়্যার ব্যবহার করতে গিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে একটি মাত্র ফোনই পরিবারের সকলে ব্যবহার করেন। আরেকটি সমস্যা হল, গ্রামগুলিতে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে না। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা নিতে গিয়ে বিভ্রাট বাধতে পারে। তাছাড়া, মোবাইল ফোনের প্রযুক্তির খুঁটিনাটি জানেন, গ্রামাঞ্চলে এমন মানুষের দেখা পাওয়া মুশকিল। ফলে হঠাৎ কোনও সমস্যা হলে পরীক্ষার্থীদের বিপাকে পড়তে হবে। শুধু আশার কথা একটাই, গত কুড়ি বছর ধরে টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত হওয়ার পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলিতে এখন ইন্টারনেট সুলভেই পাওয়া যায়।

zitlin.com

এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে তৈরি হলেন 'জিটলিন' নির্মাতারা। গোটা প্রক্রিয়াটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন তাঁরা। পরীক্ষা সম্পর্কে প্রচারের জন্য সামাজিক মাধ্যম ছাড়াও ছাপানো পোস্টার, হ্যান্ডআউটের সাহায্য নেওয়া হয়। পোস্টারগুলি দেওয়ালে সেঁটে দেওয়ার কাজে সক্রিয় উদ্যোগ নেন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ বাঁকুড়ার সংগঠক-কর্মীরা। এরপর ‘পরিদর্শক'-কে সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় ফর্ম পূরণের কাজ। ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা সংস্থার ওয়েবসাইট বা অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ব্যবহার করে পরীক্ষার জন্য নাম নথিভুক্ত করার সুযোগ পেলেন। অনলাইনেই পরীক্ষার ফি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। ব্যবস্থা হয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সেট করার। জিটলিনের সাহায্যে নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পরীক্ষার্থীরা কীভাবে মোবাইল ফোনে পরীক্ষা দিতে পারবে, তা সহজ করে দেওয়ার জন্য মূল পরীক্ষা দেওয়ার আগে আরও দু'বার তাদের বিশেষ পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা দিতে গিয়ে কোনও সমস্যায় পড়লে কীভাবে আরও একবার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়, জিটলিনের পক্ষ থেকে তাও জানানো হয়।

অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে জিটলিন অত্যন্ত উপযোগী

জিটলিন ব্যবহার করে পরীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিটি যথেষ্ট সহজ। থ্রি-জি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে স্পিডের বিষয়টি মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছে এই সফটওয়্যার। পরীক্ষা দেওয়ার সাতদিন পর পরীক্ষার্থীরা যাতে একই ওয়েবসাইট বা অ্যাপে নিজেদের পুরনো পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে রেজাল্ট জানতে পারে ব্যবস্থা রয়েছে তারও। মেধা অন্বেষণ পরীক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের লোগো দেওয়া রেজাল্ট কার্ড ছাত্রছাত্রীরা যাতে পিডিএফ ফরম্যাটে ডাউনলোড করে নিতে পারে, সেই ব্যবস্থাও করেছিল জিটলিন। হাতে-কলমে সব কিছু শিখে নিয়়ে চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তৈরি হয়ে নিয়েছিল ছেলেমেয়েরা।

নির্বিঘ্নে নেওয়া হল পরীক্ষা

মূল পরীক্ষার তারিখ ছিল ১৩ ডিসেম্বর। এদিন প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতেও নিজের বাড়িতে বসে মোবাইল ফোনে জিটলিন সফটওয়্যার ব্যবহার করে পরীক্ষা দেয় কয়েকশো কিশোর-কিশোরী। আনন্দিত ছাত্রছাত্রীরাও। করোনা অতিমারির কারণে নানা অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও মেধা অন্বেষণ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার সুযোগ তাদের করে দিল জিটলিন। এতে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষায় সুবিধা হবে তাদের। জিটলিন ব্যবহার করে মেধা অন্বেষণ পরীক্ষা চালিয়ে যেতে পেরে খুশি পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের কর্মকর্তারাও। এই পদ্ধতির ওপর পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেছেন তাঁরা।