“ছবি তোলা সহজ জিনিস, কিন্তু কী তুলব, কেন তুলব, সেটা সহজ নয়..”— একান্ত আলাপচারিতায় শিল্পী প্রতীক মন্ডল
কলকাতার ছেলে, অনেক মুহূর্ত তৈরির স্বপ্ন নিয়ে আজও স্বপ্ন বোনে... হয়তো 'ক্যামেরা ম্যান' রা "ফটোগ্রাফার" আর "শিল্পী" হিসেবে পরিচিত হওয়ার আশায় দিন গোনে... তেমন এক তরুণের কথা আর উত্তরণের বাস্তব চিত্র আজ "পরিদর্শক"এ..
শীত পেরিয়ে বসন্তের এক বিকেল। কলকাতাকে খুব ভালোবাসতো যে ছেলেটা, সেই ছেলে আজ কলকাতা থেকে অনেক দূরে... কিছুটা কাজের জন্য, কিছুটা ব্যস্ততায় আর অনেকটা অভিমানে। কলকাতায় বেড়ে সেই শিল্পী মনের মানুষটা আজ অনেক বড় স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখতে শেখায়। নিজের শহর ছেড়ে যখন অনেক দূরে, কোকিল ডাকা বসন্তের বিকেলে তখন অনেক পুরনো স্মৃতি আর নস্টালজিয়া নিয়ে হাজির হলেন আমাদের সঙ্গে। আলাপচারিতায় উঠে এল অনেক সুখ স্মৃতি, অনেক অভিমান অনেক না বলা কথা। একান্ত সাক্ষাৎকারে আজ আপনাদের জন্য পরিদর্শকের পৃষ্ঠায় রইলেন ফটোগ্রাফার ও লেখক প্রতীক মন্ডল। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও সম্পাদনায় সুকন্যা রায়।
প্রশ্ন: ‘ফটোগ্রাফার প্রতীক মন্ডল’ নিজেকে কি ছোটবেলা থেকে এভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন?
প্রতীক: ছোটবেলায় যখন রচনা লিখতে দেওয়া হত, “বড় হয়ে কী হতে চাও?”; ক্লাসের নানাজন নানা রকম লিখতো—পাইলট হতে চাই, উকিল হতে চাই ইত্যাদি। আমি কখনো লিখতে পারতাম না এরকম, আমার কাছে ব্যাপারটা ক্লিয়ার ছিলো না। কারন আমার ফোকাসড মাইন্ড ছিল না। ক্লাস নাইন- টেন থেকে কলেজ পর্যন্ত ভাবনা ছিল মিউজিশিয়ান হব। দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে নানা কাজ করতে করতে বছর ১০/১১ আগে ছবি তোলা শুরু করি। তাই এটা বলা যাবে না যে, ছোটবেলা থেকে ফটোগ্রাফারই হতে চাইতাম। তবে ১০ বছর ধরে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি বিষয়টা কোথাও আমার মধ্যে ছিল। তবে কি জানেন বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। এখন আমি কিন্তু ডিজিটাল পেন্টিং এর উপর কাজ করছি। আমি আসলে ভিজুয়্যাল আর্টের জগতে কাজ করতে ভালবাসি।
প্রশ্ন: ছোট থেকে এরকম ভিন্ন জগতে কাজ করার ইচ্ছা, আচ্ছা বাড়ির সাপোর্ট কতখানি পেয়েছিলেন?
প্রতীক: বাড়ি থেকে আমি খুব সাপোর্ট পেয়েছি; কখনো বাড়ির কেউ বলেনি তুমি তো অঙ্কে ফেল করছ, তুমি তো আসলে গোল্লায় যাচ্ছ। না, আমার বাবা-মা কোনদিন বলেনি। তাই, আমার যেটা ইচ্ছা ছিল মানে ডিফারেন্ট ওয়ার্ল্ডে কাজ করা সেটাকে আমি এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। অকপটে স্বীকার করি বাড়ির সমর্থন আর প্রশ্রয় ছাড়া এগুলো সম্ভব ছিল না।
প্রশ্ন: অনেক সময় দেখা যায় প্যাশন যখন প্রফেশন হয়ে যায় তখন প্যাশনটা মরে যায় কোথাও, সেটা হয়তো প্রফেশন বা কেরিয়ার বানানোর চাপে, আপনারও কি তাই মনে হয়?
প্রতীক: হ্যাঁ, এটা একদম ঠিক বলেছেন। বিগত কয়েক বছর ধরে আমি এটা উপলব্ধি করছি। ছবি তোলার সময় ইচ্ছেটা কিন্তু অন্যরকম ছিল। টেলিভিশনের কেরিয়ার ছেড়ে এসেছি বিভিন্ন সংগঠনের পলিটিক্সের কারণে। তখন ভেবেছিলাম ছবি তুলব। তারপর কমার্শিয়াল, টিউটরিয়াল বিভিন্ন জোনে কাজ করেছি; একটা সময় ওয়েডিং এর কাজও করেছি। বেশ কিছু বছর পর বুঝলাম, আমি যেটা পেট চালানোর জন্য করছি, সে কাজটা আসলে অন্যের জন্য কাজ করা। এখানে প্যাশনের গুরুত্ব কোথায় থাকলো? সেটা যখন মাথায় আসে দু – তিন মাসের মধ্যেই সমস্ত কাজ ক্যানসেল করে দি। কিছুদিনের মধ্যেই বম্বে চলে যাই। ওখানে চেষ্টা করি যে ধরনের কাজ আমি করতে চাইতাম সেটাই করতে। এরপর বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া; সেখানে গিয়ে একটা বিশাল বড় উপলব্ধি করি জানেন, প্যাশনটাকে বাঁচিয়ে রাখা খুব দরকার, তাতে যদি প্রফেশন ঝার খায় তো খাক।
প্রশ্ন: তাহলে বলতে চাইছেন, ক্রিয়েটিভ জগতে ফরমায়েশি কাজ একদম উচিৎ নয়, তাইতো?
প্রতীক: ঠিক, এক্কেবারে ঠিক।ডেডলাইনের মধ্যে কাজ করাটা আমি জানি কিন্তু ফরমায়েশি কাজের সমস্যা কি জানেন? আমি যেভাবে কাজটাকে দেখছি, “সময়” কিন্তু সেভাবে দেখছে না। ফলে, চাহিদা অনুপাতে যাই হোক করে কাজ উদ্ধার হয়তো করে দেওয়া যায় কিন্তু নিজের স্যাটিসফ্যাকশন আসেনা। তাই আমি এখন বাছাই করা কাজ করি আর আমি সেটা নিয়ে খুশি। যে ক’জন দর্শক আমার কাজ দেখেন সেটাই আমি প্রাপ্তি হিসেবে ধরি।
প্রশ্ন: ছবি তোলার ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচন কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?
প্রতীক: আসলে ছবি তোলাটা সহজ জিনিস কিন্তু কী তুলবো, কেন তুলবো সেটা কিন্তু সহজ নয়। বিষয় বা থিম এগুলো সময় ও প্রেক্ষিত অনুযায়ী ম্যাটার করে। আমরা কোন সেগমেন্ট কি চাইছি সেটা খুব ইম্পর্টেন্ট। যেমন ধরুন ফ্যাশনের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টের ইচ্ছেটাই হল প্রধান আবার ডকুমেন্টারির ক্ষেত্রে নিজের বিষয় নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডকুমেন্টারির ক্ষেত্রে ছবি তোলাটা অনেক পরের বিষয় তার আগের প্রস্তুতি বা বিষয় নির্বাচন বা স্টোরি বোর্ড তৈরি করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেখতে হয় বিষয়টা যেন ইউনিক হয়। আমি যে ধরনের কাজ করি সেখানে সাবজেক্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই। কোন প্রজেক্ট এর আগে আমি বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করি কি কি আছে কি কি নেই তার তালিকা প্রস্তুত করি... সবটাই করতে হয়। প্রস্তুতি পর্ব বলতে গেলে পুরো দুর্গাপুজোর মতোই অনেকটা।
প্রশ্ন: কলকাতায় জন্ম, পড়াশোনা; তারপর বিদেশেও গেছেন পড়াশোনা করতে। এখন কলকাতার বাইরে কাজের সুত্রে। যদি বলি জার্নিটা ফিরে দেখুন একবার। তাহলে কোন কোন অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করবেন আমাদের সঙ্গে?
প্রতীক: জার্নির কথা বলতে গেলেই স্ট্রাগলের কথা বলতে হয়। স্কুলের প্রথম দিন থেকে স্ট্রাগল করতে হয়েছে আজ পর্যন্তও করতে হচ্ছে। আসলেইস্ট্রাগলের চরিত্র পাল্টে যায় সময় অনুযায়ী। একটা বয়স পর্যন্ত স্ট্রাগল থাকে দৌড়ে পিছিয়ে না পড়ি। আর তারপরের স্ট্রাগলটা অর্থনৈতিক। যখন প্রথম বোম্বে যাই ২০০৪/২০০৫ সাল নাগাদ, তখনো প্রচন্ড স্ট্রাগল করতে হয়েছে। থাকার জায়গা ছিল না। এরকম দিনও দেখতে হয়েছে লাইফে কাল কী খাব জানিনা। তবে আমি বিশ্বাস করি জীবনে এই সবকটা স্ট্রাগলের দরকার ভীষণভাবে। নয়তো জীবনের নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝবার ক্ষমতা থাকত না বা তৈরি হতো না। যারা কোন প্রকার স্ট্রাগল ছাড়া তৈরি করা সিস্টেম এর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে তারা কিন্তু জীবনে অনেক স্বাদ হারিয়ে ফেলেছে বা মিস করে গেছে। জীবনের উত্থান-পতন তাদের দেখা হয় না। সে দিক থেকে এগুলো আমার জীবনে শিক্ষা। এগুলো তাই ভীষণ অপরিহার্য ছিল আমার কাছে।
প্রশ্ন: একজন শিল্পীকে ভালো দ্রষ্টা হতে হয়। প্রকৃত শিল্পী বা সাকসেসফুল ফটোগ্রাফার হতে গেলে প্রস্তুতির পর্ব বা ধাপগুলো কী কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
প্রতীক: প্রস্তুতির ধাপ কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এক হয়না। তবু কয়েকটা ধাপ যেগুলো আমার মনে হয় সেগুলো হলো – পড়া, দেখা এবং শোনা। বই পড়া কিন্তু খুব জরুরী। বাংলা সাহিত্যের এত বিশাল ভান্ডার....এই ভাষা আমার মাতৃভাষা হওয়ার বিশাল সুবিধে। বাড়িতে ১০ হাজারেরও বেশি বই ছিল চিরসঙ্গী। দ্বিতীয় হলো প্রচুর সিনেমা দেখা। এই বয়সে এসে বলতে লজ্জা করেনা যে, স্কুল কলেজ পালিয়ে প্রচুর সিনেমা দেখেছি। আমার মনে হয় শিল্পীর মধ্যে এই পাগলামো টাকা ভীষণ দরকার। তিন হলো- গান শোনা খুব জরুরী। তাতে কিন্তু আমাদের কান তৈরি হয়। এই তিনটে বিষয় রোজ অভ্যাস করলে বিশেষ একটা ক্ষমতা গড়ে ওঠে আমাদের মধ্যে। সেটা হলো চিত্রকল্প গঠনের বা visualization এর ক্ষমতা। ফটোগ্রাফারের এই ক্ষমতা থাকা কিন্তু খুব দরকার।
প্রশ্ন: সমালোচকরা বলে থাকেন ফটোগ্রাফাররা প্রকৃত শিল্পী নন কারণ তাঁরা তো নতুন কিছু সৃষ্টি করছেন না, শুধু প্রকৃতিকে অনুকরণ করছেন তারা শিল্পী হতে পারেন না। এই অভিমতকে কি আপনি সমর্থন করবেন?
প্রতীক: এটা আমার খুব পছন্দের একটা প্রশ্ন করেছেন আপনি। আসলে কি বলুন তো, এই যে এক কথায় বলে দেওয়া যে, ফটোগ্রাফাররা শিল্পী নন এটা খুব সহজ। আসলে একজন ব্যক্তি যিনি ওই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একটা মুহূর্তকে ক্যাপচার করছেন তিনি শিল্প করছেন না। বা যিনি ডকুমেন্টারিতে কাজ করছেন সেখানেও তিনি শিল্প করছেন না কারণ সেখানে তথ্য প্রধান ছবি অপ্রধান, সেটাও শিল্প করার জায়গা নয়। কিন্তু আমি যখন ছবি তুলি তখন ছবিকে শিল্প করে তুলতে চাই। প্রেক্ষিত আর গুরুত্ব অনুযায়ী তাকে উপস্থাপিত করি। আমার ছবিতে আমি দুটো সূর্য রাখতেই পারি। শিল্পের আঙিনায় তাকে তুলে ধরতেই পারি। তবেই তো সেটা ফাইন আর্টস। তবে বিষয় নির্বাচন, প্রেক্ষিত, উপস্থাপন সবকিছুতে শিল্পের ছোঁয়া থাকলে তবেই তা সার্থক। তাই, সব ফটোগ্রাফাররা শিল্পী না হলেও কোন কোন ফটোগ্রাফার অবশ্যই শিল্পী। মূল কথা হল, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিটা থাকাটা খুব জরুরি।
প্রশ্ন: ২০২০ তে এসে ফটোগ্রাফার প্রতীক মন্ডল এর একটা নতুন পরিচয়, লেখক প্রতীক মন্ডল। কী বলবেন এই বিষয়টাকে নিয়ে?
প্রতীক: ২০২০ এর ফেব্রুয়ারি থেকে চারপাশের সবটাই হঠাৎ করে চেঞ্জ হয়ে গেল। মাসের-পর-মাস ঘরবন্দি। মানে আমি ঘর থেকে বের হচ্ছি না এটা একরকম, কিন্তু আমাকে অর্ডার করা হচ্ছে, আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে ঘর থেকে বেরোনো যাবে না। আমার কাজ তো বাইরের জগতেই ; তাহলে আমি করবোটা কী?তখন আমি আর্ট নিয়ে আরো পড়াশোনা শুরু করলাম। অনলাইনে নিউইয়র্ক থেকে একটি কোর্স করলামm বুঝলাম আমি আগে কখনো পুরোপুরি ফটোগ্রাফার ছিলামই না। এই উপলব্ধি থেকে বিভিন্ন আর্টওয়ার্ক নিয়ে আমার বই লেখা। সবার কাছে নিজের ছবি নিয়ে পৌঁছে যাবার ইচ্ছে থেকেই এই বই লেখা। এই বই আমার নবজন্ম। এর আগে ভারতে খুব একটা এই বিষয় নিয়ে কাজ হয়নি। পাঠকের প্রতিক্রিয়া আশায় রয়েছি। আগামী দিনের জন্য লিখছি আরও। কলকাতার পুরনো হেরিটেজ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। ২০২০ যে স্পেস আর সময় দিয়েছে তার ফল হল এই বইটা।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন, এত বছরের কেরিয়ারে কোন বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে যেটা আপনি ভুলতে পারেন না?
প্রতীক: এক নয়, বলুন একাধিক। কলকাতার টেলিভিশনে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। তখন এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে যেগুলো দুঃস্বপ্নেও তাড়া করে বেড়ায়। আমাকে একই সময় ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যেতে বলা হয়েছে যেটা একেবারেই অসম্ভব। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের পলিটিক্স যেগুলো আমার দম বন্ধ করে দিত। তবে এটাই বলব সব ধরনের অভিজ্ঞতা জীবনকে চেনায়, চিনতে সাহায্য করে। তাই সেগুলো আমার ক্ষেত্রে পরবর্তীতে পথ চলতে অনেক কার্যকরী হয়েছে।