মহাশ্বেতা দেবী: শাল-মহুয়ার তলে আবর্তিত এক মহাজীবন
"পরাজয়ে সংগ্রাম শেষ হয় না। থেকে যায়, কেননা মানুষ থাকে, আমরা থাকি।" মহাশ্বেতা দেবী
চাইলে তিনি অগাধ অর্থ, সম্পদ আয় করতে পারতেন। কিংবা যেকোন সরকারের বদান্যতায় ভোগ করতে পারতেন আরাম-আয়েশি জীবন। দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে করতে পারতেন শখের সাহিত্যের বেসাতি। তা নয়, বরং তিনি কী না হয়ে উঠলেন প্রান্তিক মানুষের কথাকার!
যাঁদের নিয়ে পার্লামেন্টে কিংবা সাহিত্যের আঙিনায় বাহবা জেতা যায়, কিংবা সিনেমার চিত্রনাট্যে যাঁদের কালো কালো চেহারাগুলো দেখিয়ে পুরস্কার জেতা যায়। অথবা নির্বাচনের প্রাক্কালে তাঁদের খড়ের ঘরের মাটির দাওয়ায় আসন পেতে ফাইভ স্টার হোটেল থেকে আনা খাবার গলাধঃকরণ করা যায়, কিন্তু ভালোবেসে বুকে টেনে নেওয়া যায় না। হ্যাঁ, তিনি বুকে টেনে নিয়েছিলেন। নিজের ব্রাহ্মণত্বের খোলস উপড়ে ফেলে আত্মীয় করে নিয়েছিলেন আদিবাসী, দলিতদের। সেই মহাশ্বেতা দেবীর আজ জন্মদিন।
১৯২৬ সাল, ১৪ জানুয়ারি (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) আজকের এই পৌষ সংক্রান্তির দিনেই তিনি জন্মেছিলেন। বাবা ছিলেন কল্লোল যুগের খ্যাতনামা সাহিত্যিক মনীশ ঘটক, আর কাকা ঋত্বিক ঘটক। আলাদা করে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ছোটবেলায় তিনি ঘুরেছেন দেশের নানাপ্রান্তে। কখনও মেদিনীপুর, আবার কখনও ঢাকা। শেষমেশ ঠাঁই শান্তিনিকেতন। তারপর রাজশাহী কলেজ, আশুতোষ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে ঘুরে শিক্ষালাভ। কলেজে পড়াকালীন কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতি আগ্রহ। পরিচয় বিখ্যাত নাটককার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। আলাপ, পরিচয়, সম্পর্ক, আর সবশেষে বিয়ে। কিন্তু স্থায়ী হয়নি নিজের বৈবাহিক জীবন। আর শেষমেশ বেছে নিয়েছিলেন সাহিত্যের সাধনা। তা-ও আবার সেই মানুষদের জীবন নিয়ে, যাঁরা সমাজের কাছে দলিত, আদিবাসী বলেই পরিচিত।
বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন। বিয়ের পর সাংসারিক পরিমন্ডলে দারিদ্রের অভিজ্ঞতা এবং দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে যুঝে নিয়েছেন নিজের জীবনকে। তাগিদ থেকেই লিখেছেন একের পর এক সাহিত্য। আদিবাসী, দলিত, অবহেলিত মানুষের কথাকার হয়ে উঠেছেন সকলের অগোচরেই। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওঁদের (আদিবাসী, দলিত) নিয়ে লিখব বলে আমি তাঁদের কাছে যাইনি। গেছি নিজের অন্তরের টানে, আত্মানুসন্ধানের ব্যাকুলতায়। গিয়ে মনে হয়েছে এঁদের নিয়ে লিখতে হবেই, ওঁদের কথা বলতে হবেই।
অন্ত্যজ শ্রেণিদের নিয়ে লিখেছেন একের পর এক গল্প, উপন্যাস। বলেছেন তাঁদের জীবনের কথা। 'হাজার চুরাশির মা', 'অরণ্যের অধিকার', 'চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর', 'হুলমাহা', কিংবা 'শালগিরার ডাকে' উপন্যাসে সেই মানুষদের সংগঠিত লড়াইয়ের কথা বলেছেন। পেয়েছেন দেশ-বিদেশের একাধিক পুরস্কার। 'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসের জন্য পেয়েছন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। ভারত সরকারের তরফে পদ্মশ্রী, পেয়েছেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। যদিও তিনি যে আজীবন সেই সর্বহারা দলিত মানুষদের পাশে ছিলেন, তাঁদের অন্তরের আবেদন শুনেছেন, তা তো কম পুরস্কার নয়।
গত কয়েক দশকে দেশে আদিবাসী, দলিতদের অধিকার আদায়ে বহু আইন তৈরি হয়েছে। বহু সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠান অহরহ এই মানুষদের কল্যাণে কাজ করছেন। কিন্তু সমাজের অন্তর্নিহিত সত্তা থেকে আজও যায়নি সেই দলিত নিগ্রহের ঘটনা। আজও সংবাদমাধ্যম খুললেই আসে দলিত নিগ্রহের চিত্র। কখনও দলিত হয়ে ঘোড়ায় চড়ার 'অপরাধে' অত্যাচার, আবার কখনও দলিত কন্যার প্রতি পাশবিক নির্যাতনের অস্ফুট ধ্বনি। সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী সেই মানুষদের পাশে থেকেছেন। তাঁদের হয়ে সংগঠন তৈরি করে নিজেদের অধিকার আদায়ের পথে সামিল করেছেন। তিনি কেবল দলিত কথাকার নন, দলিতদের আমৃত্যু শোষণের এক প্রতিবাদী অগ্নিস্ফুলিঙ্গও বটে।
তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল পুরুলিয়াতে যেন হয় তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া। তা হয়নি, কিন্তু তাঁর চিতাভস্ম কলকাতা থেকে নিয়ে গিয়ে পুরুলিয়ার মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়েছে। আর তাঁর পাশেই পোঁতা হয়েছে একটি মহুয়া গাছ। যে মানুষের জীবনের একটা বড় অংশ শাল-মহুয়ার তলে অতিবাহিত হয়েছে, মহাশ্বেতা দেবী সেই মহুয়া তলে স্বপ্ন দেখবেন আর যেন একজন রোহিত ভেমুলার অকাল মৃত্যু না হয়, কিংবা হাথরসের মতো আর কোন দলিত কন্যার ধর্ষণের ঘটনা না ঘটে। রাজনীতির গদি বাঁচাতে কেবল দলিত তোষণ নয়, বরং তা হোক ন্যায্য অধিকার লাভের অঙ্গীকার। আর "পরাজয়ে সংগ্রাম শেষ হয় না। থেকে যায়, কেননা মানুষ থাকে, আমরা থাকি।"