ভারতে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে স্ক্রাব টাইফাস, সুরক্ষিত থাকতে কি করবেন?

নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশিত: 03/09/2021   শেষ আপডেট: 03/09/2021 10:59 a.m.
~ প্রতীকী ছবি

ইতিমধ্যেই উত্তরপ্রদেশে ৪০ জনের এই রোগে মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই শিশু

ভারতের মানুষদের জন্য এবারে আরো একটি অশনি সংকেত। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে আবির্ভাব হয়েছে আরো একটি মারণ রোগের যার নাম স্ক্রাব টাইফাস। ইতিমধ্যেই এই মারণ রোগের কবলে পড়েছেন ৪০ জনের মত মানুষ যেখানে সব থেকে বেশি সংখ্যা শিশুদের। গত সপ্তাহ থেকেই এই ভাইরাস পুনরায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেছিল। ফিরোজাবাদ, আগ্রা, মনিপুরী, কাসগঞ্জ এবং ইতহা, উত্তরপ্রদেশের এই পাঁচটি জায়গায় বর্তমানে সবথেকে বেশি স্ক্রাব টাইফাস আক্রান্তের খবর মিলছে।

ইতিমধ্যেই, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানিয়ে দিয়েছেন, উত্তরপ্রদেশে বর্তমানে স্ক্রাব টাইফাস এর জন্য ৩২ জন শিশু এবং ৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। লখনৌ এর কিং জর্জ মেডিকেল ইউনিভার্সিটির একটি মেডিকেল টিম জানিয়েছে, উত্তরপ্রদেশে স্ক্রাব টাইফাস এর মত একটি রোগ আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফ থেকে ফিরোজাবাদে একটি মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি, পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য উত্তরপ্রদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ ওরফে আইসিএমআর।

স্ক্রাব টাইফাস কি?

ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে বর্তমানে স্ক্রাব টাইফাস আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। এই রোগটি তৈরি হয় একটি ভেক্টর থেকে। এই ভেক্টরটি যখন শরীরে প্রথমবার প্রবেশ করে তখন আপনার দেহে জ্বর, ৱ্যাশ এবং তার মতো আরও বেশ কিছু উপসর্গ চোখে পড়তে থাকে। তারপরে আপনার স্নায়ুতন্ত্র এবং আপনার কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম, শ্বাসতন্ত্র এবং আপনার পাচনতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে এই বিশেষ ভেক্টর।

তারপরে আপনার দেহে নিউমোনিয়া, মেনিঙ্গ এনসেফালাইটিস, পাচনতন্ত্রের ভিতরে রক্ত পড়া, রেচনতন্ত্রের সমস্যা এবং শ্বাসতন্ত্রের বড় কিছু রোগ দেখা যেতে পারে।

এটিকে কেন স্ক্রাব টাইফাস বলা হয়?

স্ক্রাব টাইফাস রোগটির নামকরণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে দুটি পদ্ধতি। প্রথমে স্ক্রাব কথাটি এসেছে এই রোগের ভেক্টরের ধরন থেকে। পরবর্তী টাইফাস কথাটি এসেছে একটি গ্রিক শব্দ থেকে যার অর্থ জ্বর এবং তার সঙ্গে ধোঁয়া। একটি পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে বিশ্বের ১ বিলিয়ন মানুষ স্ক্রাব টাইফাস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি, সম্ভাবনা রয়েছে প্রতিবছর বিশ্বে ১ মিলিয়ন নতুন স্ক্রাব টাইফাস আক্রান্ত মানুষের খোঁজ মিলবে।

কিভাবে ছড়ায়?

স্ক্রাব টাইফাস ছড়ায় মূলত একটি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। ব্যাকটেরিয়াটির উৎস মূলত জাপান। জাপানি ভাষায় স্ক্রাব টাইফাস এর ব্যাকটেরিয়াটির বিজ্ঞানসম্মত নাম এর অর্থ রোগ ছড়ানো কীট। বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন, স্ক্রাব টাইফাস রোগটি একটি বিশেষ ধরনের পোকা কামড়ানোর পরেই হয়। গরম রক্তের প্রাণীদের সেরাম ভক্ষণ এর জন্য নিজের জীবনকালের মধ্যে একবার এই পোকাটি কোন একটি প্রাণীকে কামড়ায়। সেই সময় যদি ওই পোকাটির দেহে স্ক্রাব টাইফাস জীবাণু থাকে তাহলে ওই প্রাণীদের দেহে স্ক্রাব টাইফাস সংক্রমণ হবে।

এটা কি কোন নতুন রোগ?

ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন এর একটি পরিসংখ্যান বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্ক্রাব টাইফাস একটি মহামারী আকার ধারণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশ যেমন জাপান এবং অন্যান্য দেশে সৈনিকদের মধ্যে অদ্ভুত ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতে আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্ক্রাব টাইফাস এর একাধিক ঘটনা সামনে আসতে শুরু করে। তবে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম নয়, ভারতের আরও বেশ কিছু জায়গায় স্ক্রাব টাইফাস মহামারী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।

তবে এই ভেক্টর ঘটিত রোগের মূল উৎস ছিল উত্তর জাপান এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যবর্তী পার্শিয়ান উপসাগরের সুতসুগামুসি ট্রায়াঙ্গেল। ১৩ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জাপানের পূর্ব দিক, চীন, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া, ভারতের পশ্চিম প্রান্ত, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের বেশ কিছু জায়গায় ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়া শুরু করে।

রোগের লক্ষণ :

যদি আপনি স্ক্রাব টাইফাস পজিটিভ থাকেন তাহলে পোকা কামড়ানোর ১০ দিনের মধ্যেই আপনি আস্তে আস্তে বুঝতে পারবেন। জ্বর, কাঁপুনি, মাথাব্যথা, গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা এবং পেশিতে ব্যথা এই রোগের প্রধান লক্ষণ এর মধ্যে আছে। এছাড়াও, আপনি লক্ষ্য করবেন যে জায়গায় এই পোকাটি কামড়ে ছিল সেখানে একটা কালো দাগ তৈরি হয়েছে। মূলত সেই দাগ থেকেই আপনি স্ক্রাব টাইফাস এর শনাক্তকরণ করতে পারবেন।

চিকিৎসা :

স্ক্রাব টাইফাস রোগটি এমনই অদ্ভুত, যে এর চিকিৎসা করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এই রোগটি সঠিকভাবে শনাক্তকরণের জন্য প্রথমে রক্ত পরীক্ষা এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করতে হয়। তারপরে, শরীরে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বিচার করে পরবর্তী চিকিৎসা করা হয়। সাধারণত, বহু মানুষ যারা স্ক্রাব টাইফাসে আক্রান্ত হন তাদের হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত হতে হতে পারে। যদিও, অনেকের ক্ষেত্রে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই এই রোগের সমস্ত লক্ষণ সেরে যায়, তাদের আলাদা করে ওষুধ খেতে হয় না।

কিছু কিছু এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করলে এই রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। সাধারণত ডক্সিসাইক্লিনের মতো কিছু ব্রড স্পেক্ট্রাম এন্টিবায়োটিক এই রোগের চিকিৎসায় কাজে আসতে পারে। যারা আগে থেকেই ডক্সিসাইক্লিন গ্রহণ করেন তাদের ক্ষেত্রে এই রোগের চিকিৎসা আরো সহজে হয়ে যায়।

তবে দুঃখের বিষয় হল, এই রোগটি যেহেতু ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ছড়িয়ে থাকে তাই এর সঠিক ভাবে কোন ভ্যাকসিন নেই। এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে শুধুমাত্র এই রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব।

কোন সময়ে ছড়ায়?

জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকে জানানো হয়েছে স্ক্রাব টাইফাস সাধারণত বর্ষাকালে বেশি দেখা যায়। এখনো পর্যন্ত রাজস্থান, জম্মু এবং কাশ্মীর, নাগাল্যান্ড, উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় স্ক্রাব টাইফাস এর ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা সামনে এসেছে। বর্ষাকাল যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সবথেকে বেশি সম্ভাবনা থাকে স্ক্রাব টাইফাস এর ছড়ানোর। যদিও শুধুমাত্র বর্ষাকালে নয়, এই রোগটি শীতকালেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

বাঁচার জন্য কী করবেন?

যে সমস্ত জায়গায় বেশি সবজি থাকে, যেখানে বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকার সম্ভাবনা রয়েছে সেই সমস্ত জায়গা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। যেসব জায়গায় এই ধরনের চিগার ( ছারপোকা জাতীয় লাল রংয়ের ছোট্ট একটি পোকা ) বেশি থাকতে পারে সেই সমস্ত জায়গা বারবার ব্রাশ করুন। যদি আপনার সাথে কোন বাচ্চা থাকে, তাহলে তাকে সম্পূর্ণ জামা কাপড় পরিয়ে তারপরে বাড়ি থেকে বের করুন। আপনার শিশুকে সবসময় সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করুন। কখনোই শিশুদের গায়ে হাতে পায় অথবা কাটা জায়গায় ইনসেক্ট রেপেলেন্ট ক্রিম ব্যবহার করবেন না, বড়রা ব্যবহার করতে পারেন।