মাটিতে নয়, শূন্যে ফলবে ফসল
ভার্টিক্যাল ফার্মিং-ই কি হতে চলেছে আগামীদিনের চাষবাস?
ক্রমাগত কমে আসছে চাষের জমির পরিমাণ। এদিকে হু হু করে বাড়ছে মানুষের সংখ্যা। আগামী দিনে কী করে খাবার তুলে দেয়া যাবে এত মানুষের মুখে? দুশ্চিন্তার কারণ নেই। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন 'ভার্টিক্যাল ফার্মিং'--- চাষবাসের সম্পূর্ণ নতুন এক পদ্ধতি। কে জানে হয়তো আগামী দিনে আমাদের সবাইকে নির্ভর করতে হবে এই ভার্টিক্যাল ফার্মিং এর উপরেই!
ভার্টিক্যাল ফার্মিং আবার কী?
নামটা অচেনা লাগছে তো? লাগারই কথা। অতি সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে এই বিষয়টা। বিশেষ করে এই করোনা অতিমারির সময়ে যখন ঘরবন্দি থাকার কারণে খাবার-দাবার অমিল হয়েছিল, পাওয়া যাচ্ছিল না কাজ করবার শ্রমিক, এই সময়ে বিশ্ব জুড়ে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত দেশগুলোতে ভার্টিকাল ফার্মিং এর ব্যাপক চর্চা হয়েছে।
বিষয়টা কী?
কী এই ভার্টিক্যাল ফার্মিং? এ হল জমির বদলে মাটির উপর লম্বালম্বি করে দাঁড় করিয়ে রাখা তলে ফসল ফলাবার পদ্ধতি। এতদিন আমরা দেখে এসেছি মাটির ওপরে সমতলে চাষের ক্ষেত তৈরি করে ফসল ফলানো হয়। ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে বহুতল বাড়ি, মালপত্র বোঝাই করার বড় বড় কন্টেনার কিংবা বিশাল আকারের গুদাম ঘরে থাক তৈরি করে স্তরে স্তরে সেখানে ফসল ফলানো হয়। বদ্ধ এলাকায় চাষের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এখানেও কৃত্রিমভাবে তাপমাত্রা, আলো, আর্দ্রতা এবং বিভিন্ন গ্যাসের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের প্রধান উদ্দেশ্যই হল, অল্প জায়গায় যতটা বেশি সম্ভব ফসল ফলানো।
কিভাবে এখানে কাজ হয়?
আগেই বলা হয়েছে প্রতি স্কোয়ার মিটারে আরও বেশি করে ফসল তৈরির উদ্দেশ্যে খাড়া উঠে যাওয়া দেওয়ালের মতো কোনও জায়গায় ধাপ তৈরি করে চাষ করা হয় ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম আলো যথাযথভাবে ব্যবহার করে চাষের জায়গায় প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবস্থা করা হয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে মাটি ব্যবহার করা হয় না। পিটমস বা নারকেলের ছোবড়ার মতো খসখসে ছিবড়ে জাতীয় উপাদানের উপর করা হয় চাষের ব্যবস্থা। এতে জল লাগে খুব কম। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে সাধারণ চাষের তুলনায় ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে ৯৫ শতাংশ কম জল ব্যবহার করতে হয়।
সুবিধা কী কী?
বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের। প্রথমেই কম জমিতে বেশি ফসলের সুবিধার কথা বলা যেতে পারে। এছাড়া, সারা বছর ধরেই এতে চাষ করা যায়। জল লাগে কম। আবহাওয়া যেমনই হোক না কেন ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে তার কোনও প্রভাব পড়ে না।
অসুবিধাও কিছু আছে নাকি?
কয়েকটা অসুবিধা তো আছেই। ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে খরচ কেমন পড়তে পারে সে ব্যাপারে এখনও নির্ভরযোগ্য কোনও সমীক্ষা কিন্তু হয়নি। এই পদ্ধতিতে পরিশ্রম আছে বিপুল। ফলে সেই খাতে খরচও অনেক। তাছাড়া প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পরাগসংযোগ করানো যায় না ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, এই পদ্ধতি ভীষণভাবে প্রযুক্তিনির্ভর। কোনও কারণে একদিন বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যাহত হলে বিপুল ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
কোথায় কোথায় কাজ শুরু হয়েছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভার্টিক্যাল ফার্মিং দ্রুতগতিতে বাড়ছে। একটি হিসাব বলছে গোটা পৃথিবীতে ৩০ হেক্টর জমির সমান পরিমাণ চাষবাস হচ্ছে ভার্টিক্যাল ফার্মিং পদ্ধতিতে। শোনা যাচ্ছে আবু ধাবির মরুভূমিতে বিশ্বের বৃহত্তম ভার্টিক্যাল ফার্মিং আগামী দিনে দেখতে পাওয়া যাবে। জাপানেও কিছু কিছু কাজ হচ্ছে এই পদ্ধতিতে। ডেনমার্কের নরডিক হারভেস্ট নামের সংস্থা তাইওয়ানের ইয়েস হেলথ গ্রুপের সঙ্গে মিলে কোপেনহেগেনে তৈরি করতে চলেছে ইউরোপের বৃহত্তম ভার্টিক্যাল ফার্ম।
তাহলে?
এখনও জোর গলায় কিছু বলা না গেলেও এটুকু বলাই যায় যে, আগামী দিনে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন নানা পদ্ধতির সঙ্গে ভার্টিক্যাল ফার্মিংও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে। বিজ্ঞানীরা হিসাব দিচ্ছেন, গত ৪০ বছরে পৃথিবী হারিয়ে ফেলেছে তার মোট চাষযোগ্য জমির এক-তৃতীয়াংশ। এদিকে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা পৌঁছাবে ৯৭০ কোটিতে। ফলে মাটি ছেড়ে শূন্যে চাষাবাদ ছাড়া আর উপায় কী?