'ডোন্ট লুজ হোপ', সকল শিল্পীর প্রতি বার্তা অভিনেতা রাহুল মজুমদারের

সৃজিতা ব্যানার্জী
প্রকাশিত: 12/06/2022   শেষ আপডেট: 19/09/2022 12:21 a.m.
instagram.com/rahulmazumdar0505

অভিনয় তো আপেক্ষিক, মানুষ হিসেবে যাতে সকলের মনে থেকে যান এইটুকুই চান 'বোধি' রাহুল মজুমদার

বন্ধুর মাথা ফাটানো থেকে, গরুর পালের সঙ্গে রেস করা দস্যি ছেলেটাই আজ শান্ত স্বভাব, সারল্যের মাধুর্য দিয়ে মন জয় করেছেন দর্শকের। কেমন ছিল তাঁর সফর, খোঁজ নিল টিম পরিদর্শক

১) কেমন আছো বলো? কিভাবে সময় কাটছে এখন?

  • খুব ভালো আছি, এখন সময় কাটছে ওয়েব সিরিজ দেখে এবং প্রচুর পরিমাণে বই পড়ে। বই পড়ার নেশাটা এই মুহূর্তে নতুন ভাবে সংযোজন করেছি। এই সবকিছু মিলিয়ে খুব ভালো সময় কাটাচ্ছি।

২) টেলি দুনিয়ায় অন্যতম জনপ্রিয়, পরিচিত মুখ তুমি! এই জগতে পা রাখা কিভাবে?

  • ছোটোবেলায় ক্রিকেট খেলতাম। সেই নিয়েই এগোনোর স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আমার হাঁটু ঘুরে লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়, অপারেশন হয়। ছোটবেলায় অনেকেই মডেলিংয়ের কথা বলেছিল, কিন্তু সাহস করে উঠতে পারিনি। কিন্তু তারপর বড় হয়ে নাচে যোগ দিলাম। সেই থেকে এদিক ওদিক চেষ্টা করতে করতে একদিন হঠাৎ করে সুযোগ এসে যায়।

৩) 'দেবী চৌধুরানী' দিয়ে তোমার হাতেখড়ি, এটি একটি পিরিয়ডিক ড্রামা, সেই হিসেবে তোমায় কিরম প্রস্তুতি নিতে হয়েছে?

  • 'দেবী চৌধুরানী'র আগে আমি একটি সিনেমা করি, 'রঙ রুট'। 'দেবী চৌধুরানী'র ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা বলবো, ঘোড়া চালাতে শেখা। এই ধারাবাহিকের জন্য আমায় ঘোড়া চালানো শিখতে হয়। সঙ্গে ধুতি পরে হাঁটাচলা করতে সেরম অসুবিধা না হলেও, অনভ্যস্ত থাকার দরুন বিভিন্ন প্রকার অঙ্গ সঞ্চালন করতে প্রথম দিকে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। দুশো বছর আগের একটি প্রেক্ষাপট, সেই সময়ের প্রচলিত শব্দ-ভান্ডারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যা এখন নতুন মনে হয়, সেকালের জীবন যাপন মাথায় রেখে ফুটিয়ে তোলা, সবটা নিয়েই নিজের সমস্তটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু উপভোগ করেছি বলতে ঘোড়া চালানোটা। কারণ ছোট থেকেই ঘোড়া চালানোর একটা ইচ্ছে ছিল, সেই ইচ্ছেটা এই সুযোগে পূরণ হয়েছে।

৪) অন্যান্য চরিত্রদের তুলনায়, 'খুকুমণি হোম ডেলিভারি'তে 'বিহান' চরিত্রটি বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। 'বিহান'কে ফুটিয়ে তুলতে কিভাবে নিজেকে তৈরি করেছিলে?

  • আমার কেরিয়ারে এখনও অবধি করা সব থেকে চ্যালেঞ্জিং এবং রেসপেক্টফুল একটি চরিত্র। চরিত্রটি করার আগে প্রচুর সিনেমা দেখি যেখানে এমন চ্যালেঞ্জিং ক্যারেক্টারের উপস্থিতি আছে। এছাড়াও ফোনে সিনের অডিও আসত স্ক্রিপ্টের বদলে। সেই অডিও শুনে শুনে নিজেকে 'বিহান' এর আদলে গোছাতে শুরু করি। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হতে হতে, চারপাশ থেকে নিজের অবজারভেশনে 'বিহান'কে আরও প্রকট করে তোলার চেষ্টা করি।

৫) তোমার করা চরিত্রগুলির মধ্যে, কোন চরিত্রটি তোমার একটু বেশি কাছের যেখানে তুমি স্বয়ং 'রাহুল' কে খুঁজে পাও?

  • কোনো একটি চরিত্রে পুরোপুরি 'রাহুল'কে খুঁজে না পেলেও, সব চরিত্রের মধ্যেই কিছু বিশেষ বিশেষ দিক দিয়ে নিজেকে পেয়েছি। যেমন 'ভাগ্যলক্ষ্মী' ধারাবাহিকে বোধির মত আমি স্পষ্টবাদী। মন যুগিয়ে চলিনা, সত্যি কথা মুখের ওপর বলে দেওয়ার স্পর্ধা রাখি। 'বিহান' এর মধ্যেও যেটা আমার সঙ্গে মিল আছে, সেটা হল সারল্য। মুখে এক মনে আর এক নিয়ে থাকিনা। এক্ষেত্রেও স্পষ্ট কথা জাহির করতে পছন্দ করি।

৬) রুপোলি জগতে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় অনেক সময়। তোমার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটলে কিভাবে অতিক্রম করো? সেই নিয়ে নতুনদের উদ্যেশ্যে কিছু বলতে চাও যারা সহজে হার মেনে নেয়?

  • এই তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলিকেও আমি 'পার্ট অফ লাইফ' ই ধরি। কারণ এগুলো নিয়েই এগিয়ে যাওয়া। প্রত্যাখ্যান, অপমান, বিষাদ সবই এসেছে। তখন মেনে নিতে বা মানিয়ে নিতে সমস্যাই হত। কিন্তু এখন মনে হয় এগুলো তো জীবনেরই অঙ্গ, এগুলোও যেমন ঘটে, তেমন আজকে আমি যে জায়গায় আছি সেরকম ঘটনাও ঘটে।
    আমরা সবাই স্ট্রাগেলার । বড় বড় অভিনেতারাও স্ট্রাগেলার, হয়তো তাঁদের অথনৈতিক অবস্থার কথা ভাবতে হয়না, কিন্তু তাঁদের ছবি কিভাবে জনপ্রিয়তা পাবে তার জন্যও তাঁদের লড়াই করতে হয়। একজন শিল্পীকে তাঁর লক্ষ ভাগটুকু নিবেদন করতে হয় শিল্পের প্রতি। কাজটি ভালো হবে কি খারাপ সেটা পরবর্তী ব্যাপার। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তাঁর নিবেদিত থাকাটাই আসল। আর সবকিছুর আগে যেটা মাথায় রাখতে হবে, দুর্বল হলে চলবেনা। ডোন্ট লুজ হোপ। কঠিন শোনালেও বলি, শিল্প মানসিকভাবে দুর্বলদের জন্য নয়। কারণ এখানে ঘুঁটি যখন তখন উল্টে যেতে পারে। আজ তুমি ভালো কাজ করছো, ডাক পাচ্ছো, কাল তুমি নাও পেতে পারো। আমার নিজের ক্ষেত্রেই হয়েছে। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। বিশ্বাস রেখেছি নিজের প্রতি। আর সবকিছু শেষ করে দেওয়াও তো কোনো সমাধান নয়, এটাও মাথায় রাখতে হবে। নিজেকে সময় দিতে হবে, নিজের কাছে নিজের কদর করতে হবে সবকিছুর আগে। নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে।

৭) অভিনয়-কেরিয়ারে এখনও অবধি ঘটা সেরা মুহুর্ত কি?

  • আমি প্রতিমুহূর্ত খুব উপভোগ করি যখন শুটিংয়ে থাকি। অনেকেই বলে থাকেন তাঁদের ছবি তুলতে ভালো লাগেনা, একটানা শুটিং করতে ভালো লাগেনা, কিন্তু আমি সবটা ভীষণ আনন্দ করে করি। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর হল আমার ইন্ড্রাস্ট্রিতে। একটা দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হয়ে এসেছি। তখন ভাবতাম একদিন এমন আসবে, আমি কাজ করে যাবো, আর মানুষ আমায় ভালোবাসবেন। সেটাই এখন হচ্ছে। ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম। যখন বাইরে অনুষ্ঠান করতে যাই, অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরেও হাজার হাজার মানুষ আমায় দেখার জন্য অপেক্ষা করেন। তখন পেছনে ফেলে আসা প্রত্যাখ্যানের দিনগুলো মনে পড়ে। ঈশ্বরকে অবং অবশ্যই আমায় যাঁরা ভালোবাসা দিয়েছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

৮)তোমার বাড়ি কোথায়? বাড়িতে কে কে আছেন?

  • আমার বাড়ি দমদম ক্যান্টনমেন্ট। বাড়িতে আছেন মা, বাবা, বোন এবং প্রীতি ( স্ত্রী, অভিনেত্রী)।

৯) ছোটোবেলায় দুষ্টু ছিলে?

  • প্রচুর, সাংঘাতিক রকমের। খেলতে গিয়ে বল ফেটে যায়, তাই বলের বিকল্প হিসেবে ইঁট দিয়ে খেলা শুরু হয়। এক বন্ধুর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি সেই ইঁট ছুঁড়ে। নিজে ক্যাকটাসের গাছের ওপর পড়ে গেছি। আরজি কর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, ডাক্তার বলেন হাত কেটে বাদ দিতে হবে। তখন মনে একটাই ভয় আসে, হাত বাদ গেলে ক্রিকেট খেলবো কি করে, ক্রিকেট না খেললে শচীন হবো কি করে! মাঠে গরুদের সঙ্গে রেস লাগিয়ে উল্টে পড়ে গেছি, গরুগুলো আমার ওপর দিয়ে চলে গেছে। ভাগ্যিস ওদের পা লাগেনি আমার শরীরে! এমন অনেক ঘটনায় ভরপুর আমার ছোটবেলা। (হাসি)

১০) স্কুল-কলেজে পড়াকালীন 'ছাত্র' হিসেবে রাহুল কেমন ছিলেন?

  • বইপোকা ছিলাম না, কিন্তু ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম। সেন্ট স্টিফেনস স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, টেকনো ইন্ডিয়ায় কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বিটেক করেছি।

১১) অবসর সময় কিভাবে যাপন করো?

  • শ্যুটিংয়ের সময় অবসর পেলে প্রচুর শপিং করি, অনলাইন শপিংয়ে ঠিক তৃপ্তি হয়না, তাই নিজে হাতে করেই শপিং করে চলে আসি। শপিং করতে খুব ভালবাসি। প্রীতির থেকেও বেশি আমি শপিং করি, আগে প্রীতি করতো, এখন ও হাঁপিয়ে পড়েছে ( জোরে হাসি)।

১২) তোমার অনুগামীদের উদ্যেশ্যে কিছু কথা যদি বলো-

  • অনুগামীদের জন্য যেটা বলবো, আমায় এভাবেই ভালোবেসো, সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কক্ষনো ভাবিনি এত ভালোবাসাও আমি পেতে পারি। অভিনেতার আগেও আমি মানুষ হয়ে ভালোবাসা পেতে চাই সবার কাছে। কারণ একদিন হয়তো অভিনয় আমার কাছে থাকবেনা, কিন্তু আমার মনুষত্বের দিক দিয়ে যাতে মানুষ আমায় পরবর্তীতে মনে রেখে দেন, সেটুকুই আমার চাওয়া।