স্বাধীনতা কেবল 'সোনার পাথর বাটি'
স্বাধীনতা হোক মননে, চেতনায়
সাহিত্যের যদি দু'টি প্রধান বিভাজন ক্ল্যাসিক সাহিত্য এবং মডার্ণ সাহিত্য ধরে নিই, তেমনি স্বাধীনতারও ৪৭ পূর্ব এবং ৪৭ উত্তর স্বাধীনতার কথা বলতেই পারি। প্রথমটায়, চেনা শত্রু, যুদ্ধক্ষেত্রও চেনা; শত্রুর জাত-ধর্ম এবং রণকৌশল সম্পর্কে সজাগ সচেতনতা। আর দ্বিতীয়টায়? শত্রু অচেনা, হয়তো-বা পাশের কেউ কিংবা মেঘনাদের মতো অদৃশ্যমাণ কিন্তু রোজ বাজারের থলে হাতে টের পাই, আবার শত্রুর জাত-ধর্মের উপর আছে রহস্যের বেড়াজাল কিন্তু নির্বাচন এলেই যেন কারা জোর করে চিনিয়ে দেয়, আর রণকৌশল তো 'গণতন্ত্র' নামক শান্তি চুক্তি দিয়ে অবদমিত। ক্ল্যাসিক এবং মডার্ণ সাহিত্যের মধ্যে যদি রোমান্টিক সাহিত্য সেতুবন্ধন তৈরি করে, ঠিক তেমনি ৪৭ পূর্ব এবং উত্তর সময়ের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছে সংবিধানের কঠিন শাসনপাশ।
আজ দেশের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস। সহজ করে বললে ৭৪ বছর আগে ভারতমাতা ব্রিটিশদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়েছিল। আর গত ৭৪ বছর ধরে ভারতমাতার লালন-পালন করেছি আমরা। গত কয়েক বছরে আমরা মায়ের কতটা কাছে এসেছি জানি না, বরং যত দিন গেছে আমরা মায়ের থেকে দূরে সরে গেছি। ৪৭ পূর্ব কালে মায়ের শত্রুকে আমরা ভয় পাইনি, কিন্তু ৪৭ উত্তর চেনা শত্রুর কাছে আমরাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছি। রাষ্ট্র আমাদের শত্রু চেনাতে সাহায্য করেনি বরং শত্রুর সঙ্গে সহবাস করতে মদত জুগিয়েছে।
কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চেনা কবিতার কথা বলি -
"স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়?"
সহজ করে বললে স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে এই 'হীনতা' ভোরের আলোর মতো স্পষ্ট, চেনা। আর স্বাধীনতা উত্তর কালে এই হীনতা আরও ভয়াবহ। আমাদের চিন্তা-চেতনায়, জাতিগত সত্তায়, প্রতিদিনের জীবন-রুচিতে এই হীনতাই নীচতার নামান্তর। আমরা সংসারের মধ্যে একে অপরের কাছে হীন। আবার উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের ভূমণ্ডলে হীনতাই পরিচয়বোধক। তাহলে এই স্বাধীনতার কথাটি সত্যই 'সোনার পাথর বাটি' নয় কি? স্বাধীনতা নামক অজীর্ণ রোগের টনিক কেবলই গলাধঃকরণ করছি মাত্র, হজম করতে পারছি কি? এই 'হীন' স্বাধীনতায় কি বেঁচে আছেন কাফিল খানের মতো মানুষেরা? রাষ্ট্রের কাছে যাঁদের জুটেছে কেবল আজীবন নজরদারির তকমা! এরচেয়ে তো চেনা শত্রু ব্রিটিশদের সেলুলার জেল কম গৌরবের নয় কি?
স্বাধীনতার কথা এলে আর একজনের কথা খুব মনে পড়ে। কবি শামসুর রহমান। হয়তো-বা আজ তাঁর কবিতায় ছয়লাপ থাকবে স্যোসাল মিডিয়ার পাতা কিংবা টেলিভিশনের রঙিন পর্দা।
"স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।"
আর আজ ছয় মাস জুড়ে দেশে চলছে কৃষক আন্দোলন। ফসলের মাঠে আজ 'কৃষকের হাসি' নয়, রয়েছে দীর্ঘশ্বাস। হয়তো-বা সামান্য ব্যাঙ্ক ঋণ শোধ করতে না পারার হা-হুতাশ, আর সর্বশেষ পন্থা আত্মহত্যার আত্মতৃপ্তি! আর এই দেশের বড় বড় কোম্পানি ঋণখেলাপের পরও সুবিধা পায়, আর বিজয় মালিয়া, নীরব মোদী কিংবা মেহুল চোকসির মতো মানুষেরা সম্পদ লুটে বিদেশে গিয়ে এদেশের কারা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন!
"স্বাধীনতা তুমি মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।"
একের পর এক কারখানার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে 'দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী' আজ অনাহারে, অনাচারে শীর্ণকায়। স্বাধীনতার ৭৪ বছরে কেবলই মনে হয় শত্রু তো চিনেছি, যুঝতে পারছি না কেন?
স্বাধীনতা এবং স্বাধীন দেশ বড় গালভরা শব্দ। আচ্ছা, তসলিমা নাসরিনের দেশ কোনটি? কিংবা সলমন রুশদির? মকবুল ফিদা হুসেন কি স্বাধীনতা পেয়েছিল? আমরা কি দিতে পেরেছি? তাঁদের কণ্ঠরোধ করে আমরা কোন স্বাধীনতার গল্প শুনবো? স্বাধীনতা একটা স্বপ্ন, স্বাধীনতা একটা নতুন ভোর। যেদিন দেশের প্রত্যেকটি মানুষ ভরপেট খাবার পাবে, প্রত্যেকটি নারী মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে কিংবা কৃষক আত্মহত্যা শূন্যতে নেমে আসবে কিংবা মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে, সেদিনই তো আসবে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আসুক মননে, চেতনায়। স্বাধীনতা আসুক সম্পদের সুষম বণ্টনে, আসুক শিক্ষায়, আসুক বৈষম্যহীনতায়। ৭৫ আসুক কথা বলার স্বাধীনতায়। বেকারত্বের বন্ধন মুক্তি হোক ৭৫ তম স্বাধীনতার বেদমন্ত্র। নাহলে স্বাধীনতা কেবল 'সোনার পাথর বাটি'-র নামান্তর।