কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো। জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার, স্ত্রী ভগবতী দেবীর ইচ্ছেতেই আজ থেকে ৪১২ বছর আগে অর্থাৎ ১৬১০ সালে এই পুজোর প্রচলন করেন। বর্তমানে থিম পুজোর রেষারেষির মাঝে যে কয়েকটি বনেদি বাড়ির পুজো ধরে রেখেছে নিজেদের ঐতিহ্য, তাদের মধ্যে এই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার অন্যতম।
সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়ির পুজো মোট ৮টি বাড়িতে হয়ে থাকে। আটচালা বাড়ি,বড়বাড়ি, মেজবাড়ি, মাঝেরবাড়ি, বেনাকীবাড়ি, কালীকিংকরের বাড়ি,বিরাটি বাড়ি ও নিমতা পাঠানপুর বাড়ি―এই আটটি বাড়িতেই পূজিতা হন মা দুর্গা।
এই পরিবার পরিষদের অন্যতম সদস্য গবেষক দেবর্ষী রায়চৌধুরী জানান, "এই পুজো থেকেই প্রথম প্রচলিত হল একই চালচিত্রের মধ্যে মা দুর্গার পাশে লক্ষ্মী,গণেশ, সরস্বতী ও কার্তিকের মূর্তি ও আরাধনা।বর্তমানে মা দুর্গার সঙ্গে চার সন্তানের যে রূপ বা প্রতিমা আমরা দেখতে পাই, তা শুরু হয়েছিল এই সাবর্ণ পরিবারের হাত ধরেই।"
এই পরিবারের পুজো হয় বিদ্যাপতি রচিত "দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী" মতে; এটা কিন্তু মূলতঃ তন্ত্র মত। তবে এর আগের ইতিহাস জানাচ্ছে, ১৬৬০ এ বিদ্যাধর রায়চৌধুরীর আমলে "ত্রিধারা সঙ্গম" এসে মিশেছে এই পরিবারের পুজোয়।অর্থাৎ, শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব―এই তিন ধারার মত ও রীতিই দৃশ্যমান সাবর্ণ বাড়ির পুজোয়। যেমন, বড়বাড়ি, মেজবাড়ি ও নিমতা পাঠানপুর বাড়ির প্রতিমায় সিংহের মুখ ঠিক ঘোড়ার মত, আবার চালচিত্রতে বিরাজ করছেন দশমহাবিদ্যা ও রাধা-কৃষ্ণ। আবার বড়বাড়ি ও বেনাকীবাড়িতে নবমীর দিন কুমারী পুজোর রীতি রয়েছে।
মহাষ্টমী ও মহানবমীতে এই বাড়িতে আয়োজন করা হয় বিশেষ ভোগের।মাসকলাই,ঘি,দই দিয়ে মাখা সেই ভোগ ১৮০টি খুড়িতে অপদেবতা ও উপদেবতার জন্য সেই নিবেদন করা হয়।
সন্ধিপূজাকালে এই পরিবারের কুলদেবী মাতা ভুবনেশ্বরীর(মা কালীর আর এক রূপ) এক বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয় নিমতা পাঠানপুর বাড়িতে। পাশাপাশি উল্লেখ্য, এই পরিবারের পুজোয় বলিপ্ৰথা থাকলেও বর্তমানে কোনো পশুবলি হয়না, ফল বা নিরামিষ সবজি বলি দ্বারা প্রথাটুকু পালন করা হয়।
পরিশেষে এ কথা না বললে নয়, ৪১২ বছরের এই পুজোর বর্তমানে আর একটি মূল আকর্ষণ হল, এই পরিবার পরিষদের শারদীয়া মুখপত্র "সাবর্ণ বার্তা", যে বার্ষিক পত্রিকাটি মূলতঃ সত্য ইতিহাসের সন্ধানে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ বছর মহাষষ্ঠীর দিন অভিনেতা অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়,কবি শিবসৌম্য বিশ্বাস, সনাতন রায়চৌধুরী, সদানন্দ বটব্যাল প্রমুখ গুণী মানুষদের উপস্থিতিতে প্রকাশিত হল এই বছরের শারদীয়া সংখ্যা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার— শ্রী দেবর্ষী রায়চৌধুরী শ্রী সৌরভ রায়চৌধুরী