ঐতিহ্যের শহর, সংস্কৃতির শহর কলকাতা। আর সেই শহরের বুকের ছোট্ট একটা অংশ রোজ লেখে এক অন্য গল্প। সেই গল্পে পরিশ্রম থাকলেও নেই দশটা-পাঁচটার অফিস। নিত্যদিনের আনাগোনা থাকলেও নেই কর্মজীবনের প্রানোচ্ছলতা। বরং আছে দীর্ঘনিশ্বাস আর পর্দার আড়ালে ঢেকে রাখা অন্তবিহীন চোখের জল। যে দীর্ঘনিশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে উত্তর কলকাতার শোভাবাজারের ‘সোনাগাছি’র গলি। যে চোখের জলে নোনা ধরে পাঁচ ফুট বাই আট ফুটের ঘরগুলোতে। তবে যখন মা আসেন, কালো চোখের সমস্ত জল ঝরিয়ে হাসতে হাসতে বিদায় নেয় আকাশের সাদা মেঘগুলো, উত্তর কলকাতার পুরনো গলির ভিতর শিউলি গাছটা সন্ধ্যাবেলা ছড়িয়ে দেয় তার অপূর্ব সুবাস, তখন পাঁচটা দিনের জন্য হলেও উৎসবের রং লাগে সোনাগাছির অন্দরে। ২০১৩ থেকে পুজোর কটা দিনে বছরের বাকি দিনগুলোর সাদা কালো মুখোশ দূরে সরিয়ে দিয়ে রঙিন পোশাকে নিজেদের শরীর ঢেকে সবার সাথে পুজোর রসাস্বাদনে মেতে ওঠেন নিষিদ্ধপল্লির ষোলো থেকে ছেষট্টি। যদিও সেই পুজোতে থাকে না কোনও থিমের বাহার। মা আসেন নিত্যা হয়েই। তবে এবছরই প্রথম বারের জন্য থিমের ছোঁয়া লাগল ‘ওদের’ পুজোয়। সনাতনী মায়ের বদলে এলেন একটু ‘অন্যরকম’ মা। তাও মাত্র ১০১ টাকায়।
থিমের পুজো হচ্ছে কলকাতার সোনাগাছিতে। নবম বর্ষে পদার্পণ করা এশিয়ার সবচেয়ে বড় নিষিদ্ধপল্লির পুজোয় প্রথমবার পড়ছে থিমের ছোঁয়া। তবে থিমের আদলে বানানো চিন্ময়ী মায়ের মৃন্ময়ী রুপের জন্য খরচ হয়েছে মাত্র ১০১ টাকা। এই সামান্য টাকার বিনিময়ে তাঁদের দুর্গামূর্তি দিয়েছেন চোরাবাগান সার্বজনীন পুজা কর্তৃপক্ষ। চতুর্থীতে হয়ে গেছে উদ্বোধনও। প্রতি বছরের মতো এবারেও ছোটদের জন্য বসে আঁকো প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে বড়দের জন্য হাঁড়ি ভাঙা, মোমবাতি জ্বালানো, শাঁখ বাজানোর-মতো একঝাঁক প্রতিযোগিতার সম্ভার নিয়েই সেজে উঠেছে এবারের সোনাগাছির দুর্গোৎসব।
তবে শুধু থিমের পুজাই নয়, সহভোজেরও কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে এবছর তাঁদের পক্ষ থেকে। অষ্টমীর রাতে সারারাত জুড়ে রান্না হবে খিচুড়ি, চচ্চড়ি, চাটনি, পায়েস। নবমীর সকালে তা পৌঁছে যাবে কলকাতার নানা প্রান্তে, তাঁদেরই মতো নানা নিষিদ্ধপল্লিতে। নবমীর দুপুরে শহরের সকল যৌনকর্মীরা একইসঙ্গে খাবেন সেই খাবার। মাতবেন একাত্মীয়তার বন্ধনে। আর এই কর্মসূচীর পিছনের মূল উদ্দেশ্যও প্রকাশ করেছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির মুখপাত্র মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “আসলে আমরা যতই সচেতন হই না কেন এখনও যৌনকর্মীদের ‘পতিতা’ হিসাবেই দেখে সমাজের একটা বড় অংশ। তাই মুখে সকলের উৎসব বলা হলেও এই পেশার সঙ্গে যুক্তদের উৎসবের সাথে যোগ থাকে না বললেই চলে। এই সময় সবাই ভোগ পেতে ভালোবাসে। কারা দেবে, কি দেবে, তার পরোয়া না করার জন্যই আমরা এই কর্মসূচী নিই। কলকাতায় থাকা সকল যৌনকর্মীদের কাছেই ভোগ পৌঁছে দেওয়া হবে”। দুর্বার সূত্রে খবর, কোনও রান্নার ঠাকুর নয়, অষ্টমীর রাতে হাতে হাঁড়ি, কড়া, খুন্তি তুলে নেবেন খোদ যৌনকর্মীরাই। তাঁরাই রাঁধবেন। তাঁরাই ডেচকি ভর্তি খিচুড়ি নিয়ে পৌঁছে যাবেন মানুষের দরজায়। ন’বছর আগে ভাঙা প্রথার পর আরও একবার অচলায়তন থেকে সমাজকে মুক্ত করার ঠেকা তুলে নিয়েছেন তাঁরা নিজেদেরই কাঁধে।
কলকাতার এমন এক গলি সোনাগাছি, যেখানের চর্চা আলোর থেকে অন্ধকারেই বেশি হয়ে থাকে। তথাকথিত ভদ্রসমাজের কাছে এখনও সেখানের খেটে খাওয়া মানুষগুলো যৌনকর্মী নন, ‘পতিতা’। তবে সমাজের চোখরাঙানি, ট্যাবুকে উপেক্ষা করে তাঁরা অবিরাম প্রতিবাদের মাধ্যমে প্রতিদিন একটু একটু করে শক্ত করে নিচ্ছেন নিজেদের ভিত। দেখিয়ে দিচ্ছেন, মা দুর্গার উদ্বোধনই হয় যাঁদের ঘরের মাটি দিয়ে তাঁরা আর যাই হোক, পিছিয়ে থাকতে পারেন না। ২০১৩য় প্রথমবার লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছিলেন সেখানের নারীরা। সেই থেকে প্রতি বছর এগোনর সাথে সাথে ‘দুর্বার’ গতিতে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা। এবছর সোনাগাছির পুজোর থিম, ‘আমাদের লড়াই সকলের উৎসব, নবম বর্ষে দুর্বারের দুর্গোৎসব’। লড়াই আরও চলতে থাকবে। সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে না পৌঁছানো পর্যন্ত জারি থাকবে তাঁদের লড়াই। ‘লজ্জারূপেণ’ থেকে শুরু করে ‘শক্তিরূপেণ’, এভাবেই চলবে শোভাবাজারের লাল গলির বিবর্তন।