ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পক্ষ থেকে নেওয়া ক্লার্কশিপ পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে আবারও তৈরি ধোঁয়াশা। যার জেরে অন্ধকারে হাজার হাজার পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। সেইসঙ্গে রাজ্য লোক সেবা আয়োগের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ফের দুর্নীতির কালো মেঘ দেখতে শুরু করেছেন অনেকেই।
২০১৯ সালের প্রথমদিকে ডব্লিউবিপিএসসির তরফ থেকে ক্লার্কশিপ পরীক্ষার কথা ঘোষণা করা হয়। জানানো হয় শূন্যপদের সংখ্যা ৭২২৭ টি। বহুদিন পর এতো সংখ্যায় শূন্যপদের দেখা পেয়ে স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন চাকরিপ্রার্থীরা। যদিও প্রথম ধাপের পরীক্ষাটি হয় অফিশিয়াল নোটিশ বেরোনোর প্রায় এক বছর পর, ২০২০ সালের ২৫শে জানুয়ারি। প্রথম ধাপের রেজাল্টে উত্তীর্ণ হন ৬৬ হাজারেরও বেশি পরীক্ষার্থী। এরপর কোভিড সংক্রান্ত কারনে বন্ধ হয়ে যায় নিয়োগ প্রক্রিয়া। পরীক্ষাটির দ্বিতীয় ধাপ হয় ২০২০ সালের ৬ই ডিসেম্বর, অর্থাৎ নোটিশ বেরোনোর প্রায় দু’বছর পর।
দ্বিতীয় ধাপের দীর্ঘ ১০ মাস পর গত ২৩শে সেপ্টেম্বর অবশেষে বের হয় বহু প্রতীক্ষিত ক্লার্কশিপের ফাইনাল রেজাল্ট। তবে সেই রেজাল্ট দেখে রীতিমতো চক্ষু চড়কগাছ পরীক্ষার্থীদের! তাঁরা দেখেন ৭২২৭ নয়, পাস করানো হয়েছে মোট ৬৮৬২ জনকে। তার সাথে না আছে পাস করা কোনও পরীক্ষার্থীর নাম, জন্মতারিখ, ব্যক্তিগত নম্বর। এমনকি পরীক্ষার কাট-অফও প্রকাশ করেনি পাবলিক সার্ভিস কমিশন। আর এর পরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় বিশ্লেষণ, কাটাছেঁড়ার পর্ব। ইউটিউবের বিভিন্ন এডুকেটরের ভিডিওর তলায় আসতে থাকে বহু কমেন্ট। কেউ জানান, তিনি শিডিউল কাস্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রথম ধাপে ৮০র বেশি মার্কস পেয়েও উত্তীর্ণ হননি দ্বিতীয় ধাপে। আবার কারোর কথায়, তাঁদের চেনা অনেকে প্রথম রাউন্ডে ৫০এর কোঠাতে নম্বর পেয়েও দ্বিতীয় ধাপে উত্তীর্ণ (কমেন্টের সত্যতা বিচার করেনি পরিদর্শক)। এই নিয়ে চলতে থাকে তরজা।
তবে এর মাঝেই ঘটে আরও একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। গতকাল সন্ধ্যাবেলায় আচমকাই পিএসসি-র ওয়েবসাইট থেকে তুলে নেওয়া হয় আগের দিনের প্রকাশিত রেজাল্ট। একইসাথে পিএসসির তরফ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, গতকালের রেজাল্টটি পর্যালোচনার জন্য সাইট থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। সফল পরীক্ষার্থীদের লিস্ট যত শীঘ্র সম্ভব পুনরায় প্রকাশ করা হবে।
আর এই বিবৃতিতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন পরীক্ষার্থী মহল। তাঁরা দাবী করেন, আবারও পরীক্ষা পদ্ধতিতে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে পিএসসি। উল্লেখ্য, এর আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের তরফ থেকে আয়োজিত ফুডের সাব-ইনস্পেক্টর পদের পরীক্ষাতেও লেগেছিল দুর্নীতির আরোপ। সেই পরীক্ষায় টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সেখানেও একইভাবে একবার রেজাল্ট প্রকাশ করে সেটি সাইট থেকে তুলে নেয় পিএসসি। তবে নতুন রেজাল্টের নামে আদতে সেবার বিশেষ কিছুই পরিবর্তন করেনি ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশন। আবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় দুর্নীতির সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন সহস্রাধিক পরীক্ষার্থী। রাজ্য সরকারকে একহাত নিয়ে কিছু ছাত্রের কটাক্ষ, সরকার ভোটের আগে বলেছিল ‘খেলা হবে’। তবে এটাই কি সেই ‘খেলা’র নমুনা? অনেকের দাবী, ভবানীপুরে ভোটের স্বার্থে সাময়িকভাবে রেজাল্ট তুলে নিয়েছে পিএসসি।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরীক্ষার্থী মহলে শুরু হয়েছে ব্যাপক জলঘোলা। নতুন লিস্টে আদৌ তাঁদের নাম থাকবে নাকি ফুডের এসআই পরীক্ষার মতোই সামান্য পালিশ করেই পুরনো রেজাল্টই প্রকাশ করবে পিএসসি, তা নিয়ে ধন্ধে পড়েছেন তাঁরা। রেজাল্ট তুলে নেওয়ায় মুশকিলে পড়েছেন উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরাও। নতুন লিস্টে তাঁদের নাম থাকবে কিনা, সে চিন্তায় ঘুম উড়েছে তাঁদেরও। এর মাঝেই কিছু উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীর হুমকি, নতুন লিস্টে তাঁদের নাম না থাকলে তাঁরা এই রেজাল্টকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কোর্টে যাবেন। আবার অনেক মেধাবি কিন্তু অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থী, যাঁরা প্রথম ধাপে অভাবনীয় ফলাফল করেও দ্বিতীয় ধাপে উত্তীর্ণ হননি তাঁরাও বলছেন, নতুন লিস্টে তাঁদের নাম না থাকলে স্বচ্ছ ফলের দাবীতে তাঁরাও কোর্টের দ্বারস্থ হবেন। অর্থাৎ উত্তীর্ণ এবং অনুত্তীর্ণ, উভয় পক্ষই পড়েছেন ‘শাঁখের করাত’ পরিস্থিতিতে। কারন, সরকারী চাকরি সংক্রান্ত কোনও বিষয় কোর্টে অবধি গড়ালে তার পরিনাম কি হতে পারে তা পশ্চিমবঙ্গবাসী আগেই দেখেছে রাজ্যের প্রাইমারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অর্থাৎ টেট-এ। তাই একথা বলাই যায়, বর্তমানে হাজার হাজার যোগ্য, আশাবাদী এবং কৃতকার্য পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কার্যত অন্ধকারে।
বারবার ভুল করেই চলেছে ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশন। কিছুদিন আগে সংঘটিত রাজ্যের সবথেকে বড় পরীক্ষা ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস’-এর উত্তরপত্রেও দেখা গেছিল অসংখ্য ভুল। বিনায়ক দামোদর সাভারকার থেকে শুরু করে কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী সম্পর্কিত প্রশ্নে ভরা প্রশ্নপত্র দেখে পরীক্ষার আয়োজকদের বিশেষ রাজনৈতিক দলের ক্রিতদাস বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়েনি অনেকে। তার মাঝেই আবারও ক্লার্কশিপের রেজাল্ট নিয়ে গুরুতর ভুল! আশা থাকবে, সমস্ত ভুল শুধরে নিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জনসেবা আয়োগ।