বাংলার অন্ধকার ঘোচাতে ধর্মতলায় উপচে পড়ল মানুষের ঢল, উপস্থিত টলিপাড়ার কুশলীরা
কোন রাজনৈতিক রঙ ছাড়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সকলের লক্ষ্য ছিল।
এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার। এবার এই অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে এবারে শহরের পথে নামলো সারাবাংলা। টলিপাড়ার সদস্যরা এদিন মানবিকতার পতাকা উড়িয়ে ভিড় জমালেন মেট্রো চ্যানেলে। সাথে ছিলেন বহু সাধারণ মানুষ। কোন রাজনৈতিক রঙ ছাড়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সকলের লক্ষ্য ছিল। এমনটাই বলছেন এই অনুষ্ঠানে যোগদান করা তারকারা। অনলাইন হুমকিতে নাজেহাল বর্তমানে দেশের একটি অংশ। বহু মহিলা অভিযোগ করেছেন, তারা একবার যদি বিরোধিতা করেন, তাহলে গণধর্ষণের হুমকি আসতে সময় লাগেনা। এছাড়াও শিল্পীদের কিছু অংশ এই ধরনের হুমকি মাঝে মধ্যেই পেয়ে থাকেন। এই ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সোমবার দুপুর ৩ টে নাগাদ ধর্মতলা চত্বরে হাজির হলেন টলিপাড়ার কলাকুশলীরা।
উপস্থিত ছিলেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, সুদেষ্ণা রায়, গৌতম ঘোষ, অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিক, কৌশিক সেন, ঋদ্ধি সেন, অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ, সোহিনী সেনগুপ্ত থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী, শুভাপ্রসন্ন সহ আরো অনেকে। এদিন ধর্মতলা চত্বরে ছিল সাধারণ মানুষের ভিড়। টেলি দুনিয়া থেকে এসেছিলেন অভিনেত্রী সুচিস্মিতা চৌধুরী, শ্রীতমা ভট্টাচার্য। সকলের সঙ্গে তারাও প্রতিবাদ এর গানে গলা মিলিয়েছেন। প্রথমেই অধ্যাপক অভীক মজুমদার প্রশ্ন তোলেন, "নেতাজির জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যা হয়েছে সেটা অন্যায়। যদি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এরকম করা হয় তাহলে ভাবুন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কি করা হতে পারে।" এই একি প্রশ্ন করেছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। গৌতম বাবু বলেছেন, "এটা রাজনৈতিক মঞ্চে হয়। কিন্তু একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এরকম আচরণ কিন্তু ভাবা যায় না। যারা এরকম করলেন তাদের দলের বাকি সদস্যদের কি খুব একটা ভালো লাগলো এই ঘটনাটি? যারা রাজনৈতিক কর্মী তারা তো কাজ করছেন। পাশাপাশি যারা নাগরিক তাদেরকে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসা উচিত।"
অভিনেতা কৌশিক সেন রাস্তায় রাজ চক্রবর্তীর সঙ্গে হওয়া কথোপকথনের ব্যাপারে জানালেন। কৌশিক সেন বললেন, "রাজ আমাকে কথা দিয়েছিল, আমি যা বিশ্বাস করি তাই বলতে পারব। এই সভা এমন কোন মঞ্চ থেকে হচ্ছে না যা নির্দিষ্ট কোন মতবাদে বিশ্বাস করে।" তাই অভিনেতা স্পষ্টভাবে জানালেন, এই মুহূর্তে তার সব থেকে বড় শত্রু তৃণমূল না বিজেপি। আগের থেকেও এখন বেশি খারাপ অবস্থা। ঋদ্ধি বললেন, এই কেন্দ্রীয় সরকার জানে, কিভাবে একটা বিষয় থেকে নজর সরানো যায়। তাই সেটাই একেবারে প্রবলভাবে করা হচ্ছে। সরকারকে কোন প্রশ্ন করা হলে সেই উত্তর পাওয়া যায় না। এই উত্তর না পাওয়ার প্রবণতা সকলকে চিহ্নিত করেছে বলেও জানালেন ঋদ্ধি।
অন্যদিকে নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গ তুলে আনলেন শিল্পী শুভা প্রসন্ন। তিনি বললেন, এই কঠিন সময়ে তে একজোট হয়েছে মানুষ। ওরা জানেনা স্বামী বিবেকানন্দকে। ওরা জানেনা শ্যামাপ্রসাদ কে। শুধুমাত্র নির্বাচনী বৈতরণী পার করার জন্য ওরা তাদেরকে ব্যবহার করে চলেছে। যদি নেতাজিকে তারা জানত তাহলে ঐদিন ঐরকম ভাবে রাম ধ্বনি ব্যবহার করত না। সোহিনী সেনগুপ্ত নিজেদেরকে ভালোবাসার ডাক দিলেন। অন্যদিকে বর্ষিয়ান অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় এর বক্তব্য পড়ে শোনালেন সুদেষ্ণা রায়। অভিনেত্রী লিখে পাঠিয়েছিলেন, একবিংশ শতকে তার ভাবতেও অবাক লাগে, যখনই কোন মহিলার প্রতি ক্ষোভ উগরে দিতে হয়, তখন কেন বারবার যৌন হেনস্থার ভয় দেখানো হয়। মাধবী দেবী এই মানসিকতার প্রতিবাদ করে সকলকে একজোট হওয়ার আহ্বান জানালেন।
অন্যদিকে অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এর বক্তব্য পড়ে শোনালেন ঋদ্ধি সেন। পরমব্রত লিখেছেন, এই ধরনের বর্বর আক্রমণ মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। তাই এই মুহূর্তে সকলকে একসাথে ভেবেচিন্তে কিছু একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন পরম। অন্যদিকে লেখক শ্রীজাতর বক্তব্য পাঠ করলেন কৌশিক সেন। শ্রীজাত লিখে পাঠিয়েছেন, এই ধরনের আগ্রাসন থেকেই মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে অনধিকার প্রবেশ করছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস থেকে মানুষের লেখনি এবং পোশাক সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই এই আচরণ সভ্য সমাজে কাম্য নয় বলেও তিনি জানিয়েছেন।
অন্যদিকে মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন এবং চিত্রনাট্যের লেখিকা লীনা গঙ্গোপাধ্যায় শিল্পীদের উপর আক্রমণের কড়া নিন্দা করলেন। কবীর সুমনের ভয়েস রেকর্ড শোনানো হলো মঞ্চে। তিনি ধর্মকে ঘিরে যে রাজনীতি তৈরি হয়েছে তা নিয়ে বাংলার মানুষকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে অনুরোধ করেছেন যেন তারা আগামী নির্বাচনে ভেবেচিন্তে ভোট দেন। এর মাঝেই শ্রীতমা ভট্টাচার্য এবং মানসী সিংহ তাদের ছোট বক্তৃতা পেশ করেন। তারাও নারীদের ওপরে এই ধরনের আক্রমণের প্রতিবাদ করলেন। অভিনেত্রী উষসী চক্রবর্তী দেবলীনা এবং সায়নীর ওপরে চলা এই কদর্য আক্রমণের তীব্র নিন্দা করলেন।
এরপর মঞ্চে উপস্থিত হলেন অভিনেত্রী সাংসদ নুসরাত জাহান। মাইক হাতে নিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে নুসরাত বললেন, "বাংলার মেয়েদের ধর্ষণ করবে! কার এত ক্ষমতা! সামনে আসুক! সবাইকে দেখে নেবো। দরকার পড়লে ঝাঁটা এবং বটি হাতে তাড়া করবো।" অবশেষে প্রতিবাদের মঞ্চে উপস্থিত হলেন অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত। বেশ কয়েকদিন ধরে তার উপরে সোশাল মিডিয়ায় আক্রমণ চলেছে। তার কথায়, "গতকাল খুনের হুমকি পেলাম। আমার মায়ের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে নানা অশ্লীল মন্তব্য শুনতে হচ্ছে। নিজের জন্য না, তার জন্য ভয় হচ্ছে। এবারে বাংলার মানুষ ভাবতে শিখুন। নাহলে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের নিরাপত্তা থাকবেনা।" সবশেষে বক্তব্য পেশ করলেন সায়নী ঘোষ। তিনি বলছেন, "ফ্যাসিবাদ বাংলার মানুষের জীবনে ছড়িয়ে পড়ছে। আমার বিশ্বাস কড়ায়-গণ্ডায় মানুষ এর জবাব দেবেন।"