ধর্মের নামে বারবার সংখ্যালঘু নিধন অবক্ষয়েরই নামান্তর
"ধর্ম যতদিন দুঃখী মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস দেয়, ততদিন রাস্তা নিয়ে কারও সঙ্গে তার ঝগড়া থাকে না" বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নতুন বোধোদয়ের জন্ম দিল। দেশটিতে ঘটে চলা বারবার 'সংখ্যালঘু নিধন' কয়েক শতক আগের 'মাৎস্যন্যায়' নামক ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের মৃত্যুর পর পাল রাজাদের অভ্যুত্থানের মধ্যবর্তী যে একশো বছরের সময়কাল, ইতিহাস তাকেই বলে মাৎস্যন্যায়। ইতিহাস ক্লাসে মজা করে বলা হত - জলাশয়ে বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে গিলে খায়, তৎকালীন বঙ্গদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা তেমনই ছিল। সে তো শশাঙ্কের পরবর্তী পাল রাজাদের অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী ইতিহাস! সাম্প্রতিক বাংলাদেশ-সহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ক্রমাগত সংখ্যালঘু নিধন সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্য বহন করেই।
প্রশ্ন তোলা হয়, 'হিন্দুত্ববাদ' কিংবা 'ইসলামবাদ' কি সমার্থক নয়? অতিরিক্ত ধর্মপ্রীতি তো গোঁড়া ধর্মীয় মতবাদের অনুশাসন! ধর্মতত্ত্বের উদারনৈতিক মনোভাবকে যদি 'হিন্দুত্ব' কিংবা 'ইসলামত্ব' অভিধায় অভিহিত করা যায়, তাহলে ধর্মের কঠোর অনুশাসন কিংবা হিংসাত্মক মনোভাবই হিন্দুত্ববাদ কিংবা ইসলামবাদ বলতে কোন দ্বিধা নেই। সমস্ত মৌলবাদী চিন্তার উৎসমূলে ধর্মকে করা হয়েছে বলির পাঁঠা। ধর্মের নামে একদল সুবিধাখোর মানুষ সময়ে সময়ে এমন উসকানিমূলক কাজের মধ্য দিয়ে আসলে সেই মৌলবাদকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে দোলের আগের রাতে রাজধানী শহর ঢাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনায় টনক নড়েছে একদল মানুষের। বাংলাদেশে বারবার সংখ্যালঘু অর্থাৎ সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর আক্রমণ কোন্ ধর্মীয় সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়? সেদেশের সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সংগঠন সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছে, মূলত জমি দখলের উদ্দেশ্য নিয়ে এমনতর আক্রমণ চালিয়েছে একদল দুষ্কৃতী। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার ২২২, লাল মোহন সাহা রোডের ইসকনের একটি রাধাকান্ত মন্দিরে এই অতর্কিত হামলার ব্যাখ্যা এখনও দেয়নি বাংলাদেশ কিন্তু জনমানসে তৈরি হওয়া চাপানউতোর সংখ্যালঘু আক্রমণের ঘটনাকেই চিহ্নিত করে। কেবল বাংলাদেশ কেন পাকিস্তান-সহ বেশ কয়েকটি দেশে বারবার এমন হিন্দু আক্রমণের ঘটনায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন একদল মানুষ। আর তখনই তাঁদের বিশেষ রাজনৈতিক দল কিংবা 'মূঢ়' চিন্তার মানুষ বলে আগেই দেগে দেওয়া হয়েছে। এমন বিমাতৃসুলভ আচরণকে কী বলে ব্যাখ্যা করা যায়? এমন নীরবতার কারণই-বা কী?
গতকালের বাংলাদেশের এমন ঘটনার পর ইসকন ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমণ দাস বলেছেন, "দোল ও হোলির সময় এই ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রাষ্ট্রসংঘে দিন কয়েক আগেই ১৫ মার্চ দিনটিকে 'International Day To Combat Islamophobia' দিবস হিসেবে উদযাপনের প্রস্তাব পাশ হয়েছে।" সেই টুইটে তিনি আরও যোগ করেছেন, "আমরা অবাক হচ্ছি রাষ্ট্রসংঘ হাজার হাজার সংখ্যালঘু বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানিদের দুঃখ-কষ্টে নীরব। কত হিন্দু সংখ্যালঘু তাঁদের জীবন হারিয়েছেন, সম্পত্তি হারিয়েছেন, ধর্ষিতা হয়েছেন। আফসোসের বিষয়, রাষ্ট্রসংঘ শুধু ইসলামোফোবিয়া নিয়ে চিন্তা করে।"
ইসকন ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমণ দাসের এই যুক্তি খন্ডাই কী করে? কীভাবে বলা যায় এগুলো বিক্ষিপ্ত ঘটনা? এ তো প্রথম নয়, এর আগেও বহু এমন ঘটনা বিভিন্ন জায়গায় ঘটতে দেখা গেছে। গতবছর দুর্গাপুজোর সময় বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরের ঘটনা সারা বিশ্বেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কে বা কারা এই উসকানিমূলক কাজের জন্য দায়ী তার কি সঠিক বিচার হয়েছে কিংবা হয়? বিষয়টি বিচারাধীন, একদিন হয়তো আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু বারবার এই 'ধামাচাপা' দেওয়ার মানসিকতা কি মৌলবাদকেই প্রতিষ্ঠা দেয় না? যে ধর্মেরই হোক, যেখানেই ধর্মের নামে জোর-জুলুম ঘটবে কিংবা হিংসাত্মক পরিবেশ তৈরি করে ফায়দা লুটবে একদল মানুষ, সেখানে কি কঠোর হাতে দমন অগ্রগণ্য নয়? এমন প্রশ্ন তো উঠতেই পারে!
বারবার এমন ঘটনায় কিংবা বলা ভালো হিন্দু নিধনের ঘটনা কেন ঘটছে? কোন আগ্রাসন গ্রাস করছে মানুষের মর্মমূলে? ধর্ম তো মানুষের নিত্যকর্ম। নিজেদের সুখ-দুঃখের সাথী। সন্তানহীন মা যখন বালক কৃষ্ণকে সন্তানস্নেহে লালন-পালন করেন কিংবা কোন অসহায় মা যখন দরগায় গিয়ে নিজের সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন - সেখানে তো বাধা নেই, আপত্তি নেই। ধর্ম যতদিন মানুষকে বেঁচে থাকার আনন্দ দেয়, নিজেদের শোক-দুঃখ ভুলে হাসতে শেখায় ঠিক আছে, কিন্তু ধর্ম যখন খড়্গ হাতে রক্ত ও ধ্বংসের খেলায় মত্ত হয়ে ওঠে, সেদিন ধর্মের অপমৃত্যু ঘটে। ধর্ম তখন শান্তির পথ ভুলে হিংসার বেসাতি করতে লেগে পড়ে তখন!