মানবিকতার অনন্য নজির
গরিব পরিবারের বধির শিশুদের জীবনে আলো জ্বালছেন দুই চিকিৎসক
নিষ্ঠুর এ পৃথিবীতে মানুষ নাকি আজ বড় স্বার্থপর। কিন্তু এরই মধ্যে কখনও কখনও এমন মানুষেরও দেখা মেলে যাঁরা অন্যের জীবনে আলো জ্বালাতে নিজেদের সবকিছু যেন উজাড় করে দেন। এমনই দু'জন হলেন মুম্বইয়ের ডাঃ জয়ন্ত গান্ধী ও ডাঃ দেবাঙ্গী দালাল। প্রথমজন নাক-কান-গলা (ইএনটি) বিভাগের খ্যাতনামা সার্জেন, দ্বিতীয়জন অডিওলজিস্ট ও স্পিচ থেরাপিস্ট। এঁরা দু'জনে মিলে ২০০৪ সালে গড়ে তুলেছেন ‘জুভেনাইল অর্গানাইজেশন ফর স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং' সংক্ষেপে ‘জোশ' (জেওএসএইচ) সংস্থা। সেই থেকে গত ১৬-১৭ বছর ধরে বধির কিংবা শুনতে অসুবিধা আছে এমন এক থেকে কুড়ি বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের শব্দহীন জীবন মুখর করে তোলার ব্রত পালন করে চলেছেন তাঁরা। আসুন আজ তাঁদের কাহিনী শুনি।
বধিরতার সমস্যা ছড়িয়ে পড়ছে দুনিয়া জুড়ে
সম্পূর্ণ বধিরতা এবং ভালো করে শুনতে না পাওয়ার সমস্যা দিনে দিনে গোটা দুনিয়া জুড়ে বিরাট আকার নিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় আড়াইশো কোটি মানুষ শুনতে না পাওয়ার কোনও না কোনও রকম সমস্যায় ভুগবেন। মানে, প্রতি চারজনে একজন মানুষ একদম না শোনা, কিংবা শোনার অসুবিধায় কষ্ট পাবেন। এদের মধ্যে পড়বেন ভারতের প্রায় ৬ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ। রিপোর্টটি বলছে, চিকিৎসা করে এই সমস্যা কিছুটা অন্তত মেটানো না গেলে অসুস্থরা শুধু যে অন্যদের সঙ্গে নিজের বলতে চাওয়া কথা ভাগ করে নিতে পারেন না তাই নয়, ভাষা যেহেতু চিন্তার বাহন, তাই শুনতে যাঁদের অসুবিধা থাকে, তাঁদের মানসিক বিকাশও ঠিকমতো হতে পারে না। অথচ হিয়ারিং এড-এর মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিংবা ককলিয়া প্রতিস্থাপনের পর কিছু থেরাপির সাহায্য নিলে ছোটরা তো বটেই বয়সে বড় মানুষও যথেষ্ট উপকৃত হন।
কিছু একটা করতেই হবে
এই রিপোর্ট সামনে আসার বহু আগেই সমস্যাটি ভাবিয়েছিল ডাঃ গান্ধী ও ডাঃ দালালকে। তাঁদের ভাবিয়ে তুলেছিল হিয়ারিং এড ও তার সঙ্গে যুক্ত থেরাপির বিরাট খরচের ব্যাপারটা। তাঁরা খেয়াল করেছিলেন, চাইলেও অনেক পরিবারের পক্ষেই বিরাট খরচ সামাল দিতে না পারায় বধির সন্তানের চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উপযুক্ত চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র পরিবারের বধির ছেলেমেয়েরা বাধ্য হচ্ছে সারাজীবন বধিরতার বোঝা বইতে। কিছু একটা করতেই হবে– এই ভাবনা থেকেই কাজে নেমে পড়েন দুই চিকিৎসক। প্রথমে তাঁরা পরিচিত মহলে বিষয়টা নিয়ে নিজেদের ভাবনা ছড়িয়ে দিতে থাকেন। তৈরি হয় সাহায্য দিতে চাওয়া মানুষের তালিকা। এঁদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে হিয়ারিং এড কিনে গরিব বধির শিশুদের হাতে তুলে দেন তাঁরা। তারপর চলে তাদের ট্রেনিং দেওয়ার পালা, যাতে আর পাঁচটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতো করে এই শিশুগুলিও জীবনের পথে চলতে পারে। পাশাপাশি চলে ব্যক্তিত্ত্বের বিকাশ ঘটাতে ও কেরিয়ার বেছে নিতে সাহায্য করার পালা। এ পর্যন্ত ১৩০০-রও বেশি দরিদ্র পরিবারের বধির ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছেন এই দুই চিকিৎসক। বিনিময়ে একটি টাকাও নেননি। পরিবারগুলির কৃতজ্ঞতা ও সুস্থ জীবনের স্বাদ পাওয়া শিশুগুলির হাসিমুখই তাঁদের প্রেরণার উৎস।
বধির ছেলেমেয়েদের জন্য কাজ করে চলেছে ‘জোশ'
এই পথে চলতে চলতেই ২০০৪-এ তৈরি হল ‘জোশ' সংস্থা। বর্তমানে বধিরদের জন্য তৈরি ১২টি বিশেষ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করে জোশ। সাধারণ স্কুলের ছেলেমেয়ে যাদের শোনার অসুবিধা আছে, কিংবা ব্যক্তিগতভাবেও যদি কোনও পরিবার অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে যোগাযোগ করে, তাদের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ডাঃ গান্ধী ও ডাঃ দালাল। মাসিক ১০ হাজার টাকার নিচে যাদের রোজগার, সেই সব পরিবারের ছেলেমেয়েদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন এঁরা। প্রথমে শিশুটিকে পরীক্ষা করে তার অসুবিধাগুলি বুঝে নেওয়া হয়। বধিরতা কত শতাংশ সে সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি হয় এরপর। সেই অনুযায়ী ডাঃ দেবাঙ্গী নিজের হাতে প্রতিটি শিশুর কানে হিয়ারিং এড বসানোর কাজটি করেন। এরপর ছ'মাস ধরে চলে শিশুটিকে নতুন যন্ত্রের সাথে অভ্যস্ত করিয়ে নেওয়ার ট্রেনিং। বিশেষ স্কুলগুলিতে সাপ্তাহিক ট্রেনিং সেশনও চালান এই দুই চিকিৎসক যাতে হিয়ারিং এড পরা শিশুরা সহজেই সুস্থ ছেলেমেয়েদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে।
ছড়িয়ে দিতে হবে সচেতনতা
এই দুই চিকিৎসক লক্ষ করেছেন, মানুষের নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা পঙ্গুত্ব নিয়ে সমাজে খানিকটা সচেতনতা ও সহানুভূতি থাকলেও শুনতে না পাওয়ার সমস্যা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষই বিশেষ মাথা ঘামান না। শোনার ক্ষেত্রে একজনের কিছুটা অসুবিধা আছে– এ কথা বুঝতেও অন্যদের অনেক সময় অনেক সময় লেগে যায়। অথচ ঠিক সময়ে চিহ্নিত হলে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা হলে এ অসুবিধা দূর করা কঠিন নয়। জোশ-এর কাজ চালাবার পাশাপাশি ডাঃ গান্ধী ও ডাঃ দালাল এ ব্যাপারে সচেতনতা প্রসারের কাজও করে চলেছেন। বধিরতার সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে হিন্দি ও ইংরেজিতে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন ডাঃ দেবাঙ্গী। তৈরি করেছেন একটি টেলিফিল্ম। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেও এ বিষয় লেখাপত্র প্রকাশ করেছেন তিনি। দিনে দিনে আরও বহু মানুষ এগিয়ে আসছেন সাহায্যের ডালি নিয়ে। শক্তি সংগ্রহ করছে ‘জোশ'– শোনার সমস্যাযুক্ত ছেলেমেয়েদের কাছে নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হচ্ছে।
রশ্মিদের হাসিমুখগুলোই এই দুই চিকিৎসকের জীবনের অর্জন
শুধু বধিরতা দূর করাই নয়, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা ওই ছেলেমেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতেও সাহায্য করেন এই দুই চিকিৎসক। জোশ-এর সাহায্যে হিয়ারিং এড পাওয়া ছেলেমেয়েদের ২৫ শতাংশের মতো সাধারণ স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায়। সম্প্রতি তাঁদের চারটি ছেলেমেয়ে মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছে। ভবিষ্যতে এরা ট্রেনারের কাজ করবে। রশ্মি নামে একটি মেয়ের কথা জানিয়েছেন ডাঃ দেবাঙ্গী। গরিব সবজি বিক্রেতা পরিবারের ১৩ বছরের মেয়ে রশ্মি হিয়ারিং এড পেয়ে ‘জোশ'-এর হাত ধরে পৌঁছে গেছে স্বাভাবিক জীবনে। ক্লাসে এখন সে প্রথম হয়। একটি ছেলে ইলেকট্রনিক্সে ডিপ্লোমা পেয়েছে। ‘জোশ'-এর সাহায্য নিয়ে বধিরতার শব্দহীন জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে কেউ হয়েছে আর্কিটেক্ট, কেউ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা ফটোগ্রাফার।
ডাঃ দেবাঙ্গী জানালেন তাঁর অনুভূতির কথা। বললেন, উপেক্ষা আর অনাদরে পড়ে থাকা গরিব পরিবারের বধির ছেলেমেয়েগুলি একটু সাহায্যের ছোঁয়া পেয়ে যখন আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, আত্মবিশ্বাস অর্জন করে জীবনের পথে হাসিমুখে এগিয়ে চলে, দেখে ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয়, ‘জোশ' তৈরির উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
আরও শক্তি সংগ্রহ করুক ‘জোশ'। হাসি ফোটাক আরও অসংখ্য ছেলেমেয়ের মুখে। সার্থক হোক ডাঃ জয়ন্ত গান্ধী এবং ডাঃ দেবাঙ্গী দালালের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা– আমাদের তরফে এই শুভেচ্ছা রইল।