মাত্র ১৯ বছর বয়সী ববিতার ভাবনায়, খরার দেশে সফল হল সবুজের স্বপ্ন
দু'শো মহিলার উদ্যোগে জলসংকটের সুরাহা বুন্দেলখণ্ডে
মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড। অনুর্বর পাহাড়ি এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয় কম। প্রায় সারা বছরই জলসংকট লেগে থাকে। চাষ হয় বছরে একবার। গ্রামগুলিতে পানীয় জলের আকাল। প্রতিদিন ঘরের কাজ সেরে মাইলের পর মাইল হেঁটে জল আনতে যায় মেয়েরা। শুধু এই কারণেই স্কুলছুট হতে হয় অনেককে।
একটি অন্যরকম গ্রাম
এই এলাকারই একটি গ্রাম আগ্রোথা। সেখানকার মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা রুখে দাঁড়িয়েছেন এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে। সবই কপালের লিখন বলে বসে না থেকে জোট বেঁধেছেন তাঁরা। প্রবল উদ্যোগে পাল্টে দিয়েছেন খরাপীড়িত এলাকাটির চেহারা। সেখানকার বিস্তীর্ণ ঊষর জমিতে বছরের একটা বড় সময় ধরেই এখন সবুজ তার তুলি দিয়ে ছবি আঁকে।
২০১৮-র আগে পর্যন্ত জলাভাবের সমস্যায় জর্জরিত ছিল আগ্রোথা। অথচ গ্রামের পাশেই রয়েছে ৭০ একরের বড় একটি দিঘি। সংস্কারের অভাবে মজে যাওয়া সেই দিঘির মাত্র ৪ একর এলাকায় বর্ষার খুব সামান্য জল জমা হত। বৃষ্টি যেটুকুও বা হত, গ্রাম-লাগোয়া পাহাড়ের উল্টো দিকের ঢাল বেয়ে সব জল গিয়ে জমা হত বাছেরি নদিতে।
এসব নিয়ে ভাবত ববিতা– ববিতা রাজপুত, ১৯ বছরের এই মেয়েটি এখন বিএ-র ছাত্রী। তার মনে হত, পাহাড় কেটে যদি একটা নালা বানানো যায়, তাহলে সেই পথে বৃষ্টির জল এনে ফেলা যায় দিঘিতে। তাহলেই তো গ্রামের জলকষ্ট অনেকটা মেটে! কিন্তু পাহাড় রয়েছে বনদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে। তাদের অনুমতি ছাড়া সেখানকার একটা পাথর সরানোও অসম্ভব। তাছাড়া, দিঘির মজে যাওয়া পাড়ে ইতিমধ্যেই চাষবাস শুরু করেছে গ্রামের কিছু মানুষ। বৃষ্টির জল সেখানে জমা করতে গেলে আগে দিঘি সংস্কার করতে হবে। সে কাজে আপত্তি তাদের।
শুরু হল লড়াই
নাছোড় ববিতা বনদপ্তরের অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পাহাড়ের গা বেয়ে নালা কাটার অনুমতি আদায় করতে বার বার সে জলের অভাবে গ্রামের দুরবস্থার কথা তুলে ধরতে থাকে তাঁদের কাছে। সে এও বলে যে, অনুমতি পেলে নতুন গাছ লাগিয়ে এলাকায় বনসৃজনে সাহায্যও করবে গ্রামবাসীরা। শেষ পর্যন্ত ২০১৭-র শেষ দিকে অনুমতি মেলে। ২০১৮-র জানুয়ারিতেই কাজ শুরু করে ববিতা। গ্রামের মহিলাদের উৎসাহিত করতে থাকে কাজে হাত লাগানোর জন্য। এগিয়েও আসেন অনেকে। অনেকেই আবার পরিবারের কর্তাদের আপত্তির কারণে ঘরের বাইরে বেরোতে পারেন না।
এই অবস্থায় ২০১৮-র মাঝামাঝি সময়ে গ্রাম পরিদর্শনে আসে ‘পরমার্থ সমাজসেবী সংস্থা' নামে একটি অ-সরকারি সংগঠন। জল-সমস্যা সমাধানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তারা। উৎসাহী ১২ জন মহিলাকে ‘জল সহেলী' নাম দিয়ে তারা তৈরি করে একটি গোষ্ঠী। নাম দেয় ‘পানি পঞ্চায়েত'। ববিতা ছিল এই গোষ্ঠীর একেবারে সামনের সারিতে নেতৃত্বের ভূমিকায়। গ্রামবাসীদের আস্থা অর্জন করতে প্রথমে পাহাড়ের গা ঘেঁষে তারা তৈরি করে তিনটি ছোট ‘চেক বাঁধ'। অচিরেই সুফল ফলে। বর্ষার মরশুম শেষ হয়ে গেলেও চেক বাঁধে জমা হওয়া বৃষ্টির জলে চাষ করতে সক্ষম হন আগ্রোথার মানুষ। ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়ে তাদের। একে একে এগিয়ে আসেন প্রায় ২০০ জন মহিলা। শুরু হয় নালা তৈরির কাজ। কয়েকজন পুরুষও পাশে দাঁড়ান। ৭ মাস ধরে ববিতা ও তার দু'শো সহযোগী কঠোর পরিশ্রম করে পাহাড় কেটে তৈরি করেন ১২ ফুট চওড়া ও ১০৭ মিটার লম্বা এক নালা।
ধরা দিল সাফল্য
পরের বছরটাই ছিল খরার বছর। ২০১৯ সালে বৃষ্টি হয়েছিল খুব অল্প। কিন্তু সেবার আর জলকষ্টে ভুগতে হয়নি আগ্রোথার মানুষকে। মহিলাদের তৈরি করা নালা বেয়ে বৃষ্টির সমস্ত জলটুকুই জমা হয় দিঘিতে। ভরে যায় দিঘির প্রায় ৪০ একর এলাকা। শুধু তাই নয়, জমা জলের কারণে জমি ভিজে থাকায় মূল চাষের পরে আরও একবার চাষ হয় সেবার। এলাকার চাষি রামরতন রাজপুত বললেন, গ্রামে জলের প্রয়োজন সবটুকু মিটে গেছে এমন নয়। কিন্তু এখন অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটাই ভাল। আগে শীতের শেষ থেকেই জলকষ্ট শুরু হত, চলত বর্ষা আসা পর্যন্ত। এখন শুধু গ্রীষ্মকালেই জলের অসুবিধা দেখা দেয়, বছরের বাকি সময়ে নয়।
চাই লড়াইয়ের স্বীকৃতি
ববিতা জানিয়েছেন, খরার বিরুদ্ধে লড়াইটা জিতে নিয়েছেন মহিলারা। এখন তাঁরা বনদপ্তরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো গোটা গ্রাম জুড়ে শয়ে শয়ে গাছ লাগাচ্ছেন। এতে আগামি দিনে এলাকায় বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা তৈরি হবে। জলাভাবের মতো কঠিন সমস্যা মোকাবিলায় যেভাবে আগ্রোথার মহিলারা এগিয়ে এসেছেন, এতে খুশি ববিতা। বলেছেন, এই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে মহিলাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, গ্রামে তাঁদের মর্যাদাও বেড়েছে। তিনি চান, তাঁদের ভূমিকাকে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিক সকলে।