আত্মবিশ্বাস, জেদ, মনের জোর থাকলে কোন বাধাই পথরোধ করতে পারে না। জীবনে অভাব থাকবে, চোখে জল থাকবে, নিজেকে নিঃশেষে পুড়িয়ে ফেলা থাকবে, তারপরেও লড়াইয়ের ময়দানে অদম্য জেদ মানুষকে সাফল্যের সিঁড়িতে পৌঁছে দেবে। হ্যাঁ, অচিন্ত্য, বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ের অচিন্ত্য শিউলি (Achinta Sheuli) তাই করে দেখিয়েছেন। বাঙালি যে আজও 'জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে' তাই করে দেখালেন। আনন্দে উন্মাদনায় বাঙালির চোখে জল। এতদিন মনের ভেতর লালন করা প্রতিটা বাঙালির বেদনা নিঙড়ে জয় ছিনিয়ে আনলেন অচিন্ত্য। সত্যই আজ গর্বের দিন। বুক ফুলিয়ে বলার দিন!
হাওড়ার অচিন্ত্য শিউলির চলতি বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে (Commonwealth Games 2022) ভারোত্তোলন বিভাগে সোনা জয়। তিনিই প্রথম বাঙালি কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতলেন। বাংলার আকাশে যেন নতুন এক সূর্যোদয়। টুর্নামেন্টে অচিন্ত্যের এমন অনবদ্য পারফরম্যান্স দেখে হতচকিত গোটা দুনিয়া। যেন এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। নিখুঁত অনুশীলনের ফল পেলেন বাংলার অচিন্ত্য।
ভারোত্তোলনের ৭৩ কিলো বিভাগে স্ন্যাচিংয়ে অচিন্ত্য অনায়াসে রেকর্ড গড়লেন। প্রথম চেষ্টায় তুললেন ১৩৭ কিলো। পরের বার ১৪০ কিলো এবং শেষ বার ১৪৩ কিলো তুললেন। ক্লিন এবং জার্ক বিভাগে প্রথম চেষ্টায় অচিন্ত্য তোলেন ১৬৬ কিলো। পরের বার ১৭০ কিলো তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হলেও তৃতীয় চেষ্টায় সেই ওজন তুলে দেন তিনি। গেমস রেকর্ড গড়েন মোট ৩১৩ কিলো তুলে। চলতি কমনওয়েলথ গেমসে এই নিয়ে ভারতের তৃতীয় স্বর্ণপদক। তা-ও বাংলার ছেলে অচিন্ত্যর হাত ধরে। বাংলা তথা দেশের কাছে এ এক দারুণ গর্বের মুহূর্ত।
হাওড়ার দেউলপুরের বেড়ার ঘরে এখন আলোর রোশনাই। বাংলার প্রতিটি ঘরেই খুশির জোয়ার। বাবা ছিলেন রিকশাচালক। বছর ন'য়েক আগে মারা যান। মা জরির কাজ করেন। 'নুন আনতে পান্তা ফুরোয়' অবস্থা। একমাত্র দাদা যাঁর স্বপ্ন ছিল ভারোত্তোলক হওয়ার কিন্তু সংসারের যাঁতাকলে স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু দাদার স্বপ্ন বাস্তব করলেন যোগ্য ভাই। পদক জয়ের পর সরাসরি সেই পদক উৎসর্গ করলেন নিজের দাদা এবং কোচকে। নিজেই সগর্বে বিশ্বের এতবড়ো মঞ্চ থেকে জানালেন, "এই পদক আমি আমার দাদা এবং কোচকে উৎসর্গ করছি।"
না, কোন বাধাই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না। অভাববোধ মানুষকে আরও সাহসী, আরও তীক্ষ্ণ, ক্ষুরধার করে তোলে। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ অচিন্ত্য শিউলি। এ যাবৎকাল বাংলার ইতিহাসে নতুন মাইলফলক তৈরি করলেন অচিন্ত্য। গর্ব তো বটেই, সঙ্গে অহংকারও।