২৪ নভেম্বর, ২০২৪
কলকাতা

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নতুন ভাবনা

বিয়েতে নেই ‘কন্যা সম্প্রদান' অনুষ্ঠান - সমমর্যাদার ভিত্তিতে একসঙ্গে পথ চলার শপথ বর-কনের
‘Shubhamastu’ - “let it prosper” Bengali News
- vice.com
srirupa-banerjee
শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশিত: ৭ মার্চ ২০২১
শেষ আপডেট: ৪ এপ্রিল ২০২১ ৬:০৫

‘‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর“ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর''– লিখেছিলেন কবি নজরুল। কবিরা সত্যদ্রষ্টা হন। সমাজে নারীর অবস্থান যখন ছিল নিতান্তই পিছিয়ে-থাকার দলে, তখনই কবির চোখে ধরা পড়েছিল নারীর সৃষ্টিশীল রূপ। নরের পাশে নারীর সমমর্যাদার অধিকার তাই ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। আর আজ তো যুগ পাল্টেছে। দুনিয়া জুড়ে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে দশভুজা নারী এখন পুরুষের পায়ে পা মিলিয়ে সমান তালে হাঁটছে। মেধা, বুদ্ধি, সাহস ও দক্ষতার জোরে নারী আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান অধিকারের দাবিদার।

Shubham Astu Bengali News
নন্দিনী ভৌমিক - facebook.com/nandini.chakravarty.16

তবুও প্রশ্ন অনেক

কিন্তু সমাজ কি নারীকে পুরুষের সমান উচ্চতায় ঠাঁই দিতে রাজি? আজও কেন ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে নারী-পুরুষে এত বৈষম্য? আজও কেন হিন্দু বিবাহ-রীতিতে কন্যা সম্প্রদানের রীতি বজায় রয়েছে? মেয়েরা কি কোনও বস্তু বা পরিবারের সম্পত্তি, যা দান করা যায়? কেন শুধু মেয়েকেই সিঁদুর পরে বিবাহের চিহ্ন শরীরে ধারণ করতে হয়? কই পুরুষের বেলায় তো এমন নিয়ম নেই!

এসব প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই ভিড় করছে প্রগতিশীল মানুষের, বিশেষ করে আত্মমর্যাদাবোধের অধিকারী মেয়েদের মনে। অনেকে জমে থাকা প্রশ্ন ও তাকে ঘিরে ক্ষোভ-অভিমান বুকে নিয়েই বসছেন বিয়ের পিঁড়িতে। অর্থ না বুঝেই উচ্চারণ করছেন পুরোহিতের উচ্চারিত মন্ত্র। প্রতিবাদ করার ইচ্ছে হয় না তা নয়, কিন্তু অভিভাবকদের চাপ, সমাজের চোখ-রাঙানি এড়াতে চুপ করেই থাকেন তাঁরা।

হাঁটতে হবে নতুন পথে

এ সব প্রশ্ন ধাক্কা দিয়েছিল নন্দিনী ভৌমিক আর রুমা রায়কেও। শিক্ষাবিদ নন্দিনী হলেন একজন ভারততত্ত্ববিদ ও নাট্যকর্মী। সংস্কৃতের অধ্যাপিকা ও গায়িকা রুমা রায় তাঁর কলেজ-বন্ধু। পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে গড়া হিন্দু বিবাহের রীতি-পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে এঁরা দু'জনে সেমন্তী ব্যানার্জী ও পৌলমী চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন মহিলা-পুরোহিতদের সংস্থা ‘শুভমস্তু'। বৈদিক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এঁরা তৈরি করেছেন নতুন বিবাহ-মন্ত্র। এই চার নারী-পুরোহিতের নির্দেশনায় সহজবোধ্য ভাষায় সে মন্ত্র আবৃত্তি করে সমান অধিকারের ভিত্তিতে বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়ছেন আধুনিক যুগের বর-কনে। কন্যা সেখানে পিতার পরিবারের সম্পত্তি নন, বর নন কন্যার ভাবী জীবনের প্রভু। গানের সুরে, মন্ত্রোচ্চারণের পবিত্রতার মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসার ভিত্তিতে জীবননদী পাড়ি দেওয়ার শপথ নিচ্ছেন স্বামী ও স্ত্রী। নতুন এই বিবাহ-পদ্ধতি ইতিমধ্যেই মন কেড়েছে বহু জনের। হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানের় মধ্যে মিশে থাকা পুরুষতন্ত্রের জাল ছিঁড়ে এই চার মহিলা-পুরোহিত সমাজের বদ্ধ জলে যেন আধুনিকতার ঢেউ তুলেছেন। কেমন করে শুরু হয়েছিল নতুনের এই অভিযান? আসুন চোখ রাখা যাক সেই ইতিহাসে।

'Shubhamastu' - Dr Nandini Bhowmik, Ruma Roy, Semanti Banerjee, and Paulomi Chakraborty Bengali News
- vice.com

শুরুর শুরু

সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ কবি অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপাল তখন বেদ নিয়ে গবেষণা করছেন। নন্দিনী ও রুমা প্রতি সপ্তাহে তাঁর বাড়িতে যেতেন লাইব্রেরি গুছিয়ে দেওয়ার কাজে। ২০০৮-এ যখন সেই কাজ তাঁরা শেষ করে এনেছেন, সেই সময়ে আসে এক অভাবনীয় প্রস্তাব। গৌরীদেবী জানান, বেদ-গবেষণার ভিত্তিতে হিন্দু বিবাহ পদ্ধতিকে জটিলতা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন তিনি, সংস্কৃত মন্ত্র অনুবাদ করছেন সহজ ভাষায়। নারী-পুরুষের সমতার ভিত্তিতে তৈরি করা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে বিবাহ সম্পন্ন করার কাজও শুরু করেছেন তিনি। ১৯৯১ সালে প্রখ্যাত লেখিকা বাণী বসুর কন্যার বিবাহ এই পদ্ধতিতেই সম্পন্ন করেছেন গৌরীদেবী। নন্দিনী ও রুমাকে এতে সামিল হওয়ার অনুরোধ করেন গৌরীদেবী। সানন্দে রাজি হন তাঁরা।

সেই শুরু। গৌরীদেবীর নির্দেশনায় নন্দিনী ও রুমা মহিলা-পুরোহিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ২০০৯ সালে নিজের কন্যার বিবাহ এই পদ্ধতিতে নিজেই সম্পন্ন করেছেন নন্দিনী। একে একে পরিচিত জনদের বিবাহ সম্পন্ন করার কাজও হাতে আসতে থাকে তাঁদের।

নতুন হাওয়া

দিন যায়। নতুন বিবাহ পদ্ধতিটিকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত, আরও রঙিন সাজে সাজানোর প্রয়োজন অনুভব করেন নন্দিনী-রুমা। গৌরীদেবীর অনুমতি নিয়ে বৈদিক মন্ত্রের সাথে আরও বহু কিছু যোগ করেন তাঁরা। এই সময়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন গায়িকা সেমন্তী ব্যানার্জী ও নাট্যকর্মী স্কুলশিক্ষিকা পৌলমী চক্রবর্তী। নন্দিনী-রুমা যখন ব্যস্ত বৈদিক মন্ত্র নিয়ে গবেষণা, সেগুলি অনুবাদ করা ও বিবাহ পদ্ধতির স্ক্রিপ্ট লেখায়, সেমন্তী-পৌলমী তখন গোটা বিষয়টিকে সাজিয়ে তুলছেন অনুষ্ঠানের উপযোগী রবীন্দ্রসঙ্গীতে, রবি ঠাকুরের গানের বাণীকে মন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার কাজে। কয়েক বছর পর তাঁদের মনে হল, সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করা দরকার। গবেষণায় আরও বেশি করে ডুব দিলেন এই চার মহিলা-পুরোহিত। বেদ ঘেঁটে নারী-পুরুষের সমতার ভিত্তিতে নতুন বিবাহ পদ্ধতি নির্মাণে মনোযোগ দিলেন তাঁরা। এই সময়েই কন্যা সম্প্রদানের আচারটি বাদ দেওয়া হবে বলে স্থির হল। স্ক্রিপ্টে যোগ করা হল আটটি নতুন বৈদিক মন্ত্র। পুরনো রীতিতে শুধু কন্যাকে স্বামী ও শ্বশুরকুলের সদস্যদের সুস্বাস্থ্য-সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করতে হত। নতুন পদ্ধতিতে ঠিক হল, বর ও কনে– উভয়ে উভয়ের পরিবারের সদস্যদের সুখ-সমৃদ্ধি প্রার্থনা করবেন। চার পুরোহিত যোগ করলেন এমন এক আশীর্বাদ মন্ত্র যা ব্যবহৃত হয়েছিল প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিবাহ-লগ্নে। পুরনো বস্তাপচা ধর্মীয় ঐতিহ্যে আঘাত হেনে বিয়ের পবিত্র লগ্নের নিয়মও প্রত্যাখ্যান করলেন এই চার মহিলা-পুরোহিত। তাঁদের বিশ্বাস, সব দিনই শুভ দিন। আধুনিক নারী-পুরুষের অনেকেই সাগ্রহে বরণ করেছেন নতুন এই বিবাহ পদ্ধতিকে। সংবাদমাধ্যমে ছবি সহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে সমাজসংস্কারে অগ্রণী চার সাহসী নারী-পুরোহিত নির্মিত বিবাহ অনুষ্ঠান নিয়ে।

পার হতে হয়েছে অনেক বাধা

প্রচারের চড়া আলো এখন ‘শুভমস্তু'র ওপর। কিন্তু প্রথম থেকেই সব কিছু এত সহজ ছিল না। শুরুর বছরগুলিতে কাজ প্রায় পেতেনই না চার মহিলা-পুরোহিত। বিয়ে হবে অথচ থাকবেন না ব্রাহ্মণ পুরুষ-পুরোহিত– তখন ভাবতেই পারতেন মানুষ। যে সব অনুষ্ঠানে নন্দিনীরা ডাক পেতেন, কাজ শেষ করার পর দেখতেন, নতুন করে পুরুষ পুরোহিতকে দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হচ্ছে। বহু সাক্ষাৎকারে পুরুষ পুরোহিতরা এমনও বলেছেন– নারী অপবিত্র। ফলে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার অধিকার নেই তাদের। পুরুষতন্ত্রের এই আঘাতে দুঃখ পেয়েছেন ‘শুভমস্তু'র চার সদস্য, কিন্তু দমে যাননি। ধৈর্য ধরে সমাজ-মননে পরিবর্তন আসার অপেক্ষা করতে করতে নিজেদের কাজ চালিয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে সময় বদলেছে। ধীরে ধীরে পাত্র-পাত্রীর অভিভাবকরা অন্তর থেকে গ্রহণ করেছেন ‘শুভমস্তু'র এই উদ্যোগ। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে রুমা রায় বললেন, ‘‘সত্যি বলতে কী, আমাদের সমাজে নারী-পুরুষে বৈষম্য এত তীব্র যে বিবাহ অনুষ্ঠানে আমাদের আনা পরিবর্তনগুলোকে অনেকেই স্বাগত জানাচ্ছেন। তাঁরা যেন এর অপেক্ষাতেই ছিলেন।'' তবে যতক্ষণ না বর ও কনে উভয়ের পরিবার নতুন বিবাহ পদ্ধতি অন্তর থেকে গ্রহণ করছে, ততক্ষণ কাজের দায়িত্ব নেন না এই চার মহিলা পুরোহিত।

Woman priest who performs weddings without kanyadaan Bengali News
- vice.com

পেশা নয়, অন্তরের তাগিদ

নন্দিনী-রুমা-সেমন্তী-পৌলমীর কাছে বিবাহ অনুষ্ঠানগুলি শুধু একটা কাজ নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে তাঁদের হৃদয়ের গভীর আবেগ। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে যথাযোগ্য গুরুত্ব সহকারে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন তাঁরা। বিয়েবাড়ির উপযুক্ত ঝলমলে শাড়ি, গয়না পরে নিজস্ব মাইক্রোফোন নিয়ে অনুষ্ঠান শুরুর আধঘন্টা আগেই বিয়েবাড়িতে পৌঁছে তাঁরা ব্যবস্থাপনা শুরু করেন। প্রথমে বর ও কনের মা-বাবা, পরে পাত্র-পাত্রী ও সবশেষে নিজেদের পরিচয় তাঁরা ঘোষণা করেন উপস্থিত অতিথি-অভ্যাগতদের সামনে। জাত-পাতের বৈষম্য দূরে রাখতে তাঁরা বলেন নামের শুধু প্রথম অংশটুকু। এরপর শুরু হয় বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ। সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজিতে পাঠ করা হয় মন্ত্র। অবাঙালি বিবাহে হিন্দিতেও মন্ত্রপাঠ হয়। মন্ত্রগুলি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করেন নারী পুরোহিতরা, যাতে বর-কনে সহ উপস্থিত সকলে অর্থ বুঝতে পারেন। বর ও কনে উভয়ে উভয়ের কপালে এঁকে দেন সিঁদুরের টিকা। শপথ নেন, সাংসারিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার। পুষ্পবৃষ্টি ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে শেষ হয় অনুষ্ঠান।

বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য যে সাম্মানিক অর্থ হাতে আসে, তার অর্ধেকটাই সমাজকল্যাণ সংস্থায় দান করেন ‘শুভমস্তু'র এই চার মহিলা পুরোহিত। এ কাজ তাঁদের পেশা নয়, অন্তরের তাগিদ। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান সমাজে একজন নারী ও একজন পুরুষকে একসঙ্গে থাকার, জীবননদীতে ভেলা ভাসানোর, প্রতিকূলতার ঢেউ এলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার বৈধতা দেয়। এ হেন বিবাহের় অনুষ্ঠানটি থেকে পুরুষতন্ত্রের শিকল খুলে নিয়ে সমমর্যাদার ভিত্তিতে তাকে প্রতিষ্ঠা করাই লক্ষ্য নন্দিনী-রুমা-সেমন্তী ও পৌলমীর।

‘শুভমস্তু'র অগ্রযাত্রা শুভ হোক– আন্তর্জাতিক নারী দিবসে চার মহিলা-পুরোহিতের জন্য এই শুভেচ্ছা।

আরও খবর

বিজ্ঞাপন দিন

[email protected]

২৩ আগস্ট

বর্ষা হোক আনন্দময়, গানে ও মজায় সামিল থাকুন সপরিবারে

Concert
২০ জুন

সকাল থেকেই শহরের আকাশ আংশিক মেঘলা

Rain taxi kolkata
১৪ জুন

কসবার জনপ্রিয় শপিং মলে বিধ্বংসী আগুন

Acropolis fire
২৭ এপ্রিল

ভোজনরসিক হলে ঢুঁ দিতে ভুলবেন না এই দোকানে

Rupa restaurant
১৯ এপ্রিল

নিউটাউনের একটি বিলাসবহুল ব্যাঙ্কোয়েটে বসেছে তাঁদের বিয়ে আসর

Rupanjana Mitra
২৮ ফেব্রুয়ারি

কফি হাউসের বইচিত্র সভাগৃহে গতকাল আয়োজিত হল এক বিশেষ আলোচনা সভা

Mrinal sen conference 1
১২ জানুয়ারি

সকলকে স্বামীজির মতাদর্শ মেনে চলার পরামর্শ অভিষেকের

Abhishek Swami ji
৬ জানুয়ারি

বিয়ের পর লন্ডনে যাবেন সোহিনী বন্দ্যোপাধ্যায়

Udan tubri
৩১ ডিসেম্বর

রুশা, সুদীপ্তা কিংবা মিষ্টি-সন্দীপ্তা কিংবা সৌরভ বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন কোন কোন টলিউড তারকারা?

Param piya Sudipta
৩ ডিসেম্বর

১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে বসতে চলেছে বিবাহ বাসর

Darshana reveal