পুরুলিয়া, মানভূম, ছোটনাগপুর এইসব অঞ্চলের কথা বললেই উঠে আসে ছৌ নাচ, টুসু, ভাদু, করম পরবের কত কথা। আরণ্য পরিবেশের সঙ্গে হাজার হাজার বছরের কত মানুষের নিবিড় সম্পৃক্ততা। তাঁদের কথাবলা, খাদ্যাভ্যাস, জীবনচিত্র, নাচ-গান, উৎসব - সবেরই সঙ্গে পরিবেশের কী গভীর যোগাযোগ। পরিবেশ ও মানুষ এই আত্মিক যোগাযোগ হয়তো এই জনজাতির মানুষদের সঙ্গেই মানায়। কেবল এঁরা নন, পৃথিবীর সকল প্রান্তিক মানুষের সঙ্গেই হয়তো প্রকৃতির ঘনপিনদ্ধ সম্পর্ক।
আধুনিক বিশ্বায়নের দুনিয়ায় যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু মানুষের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত - তাই তো হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সেই তালিকায় বাদ নেই কত নৃত্যশৈলী, কথ জনজাতির হারিয়ে যাওয়া 'আঁতের কথা'। এবার একজন তরুণ চিত্রনির্মাতা তথা সাংবাদিকের তথ্যচিত্রে উঠে এল তেমনই হারিয়ে যেতে বসা নৃত্যশৈলীর অনবদ্য শিল্পভাবনা। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেই তথ্যচিত্র স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বাস, আগামী দিনে এই কাজ বহু জায়গায় সমাদৃত হবেই।
পুরুলিয়ার ভূমিপুত্র আমজাদ কাজি (Amjad Kaji) এমনই দুঃসাহসিক কাজে হাত দিয়েছিলেন বছর তিনেক আগে। এর আগেও তিনি এক তথ্যচিত্রে জঙ্গলমহল অধ্যুষিত মাওবাদীদের ডেরায় পদার্পণ করেছিলেন। কিংবা আর একটি ডকুমেন্টরি ফিল্ম 'ফাইট ফর পুরুলিয়া' বিদগ্ধ মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। এবার তিনি ছোটনাগপুর অঞ্চল লাগোয়া অন্তত ১২ টি লুপ্তপ্রায় নৃত্যশৈলী নিয়ে নির্মাণ করেছেন, 'ডান্স অফ দ্য ফরেস্ট'। যা কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার নন্দন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতে চলেছে।
সহজে এই কাজ সম্পন্ন হয়নি। পরিকল্পনা হলেও আর্থিক সংকট তথ্যচিত্রটির প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এগিয়ে আসেন পুরুলিয়ার আর এক ভূমিকন্যা, প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী শর্মিলা মজুমদার। তিনি তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, "বছর তিনেক আগে ছোটনাগপুর মালভূমি, মানভূম অঞ্চলের ১৩/১৪টি লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি/নাচকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় বা সংরক্ষণ করা যায় সে নিয়ে যে ভাবনা দানা বেঁধেছিল, আলোচনা হয়েছিল শ্রী আমজাদ কাজী ও আমার ... তা আজ রুপ নিয়েছে একটি সম্পূর্ণ তথ্যচিত্রে।"
এই তথ্যচিত্রে অসংখ্য মানুষ কাজ করেছেন। চিত্রনাট্য এবং সংলাপ রচনা করেছেন সোমা বসু, সঙ্গীত দিয়েছেন তীর্থ বিশ্বাস, সম্পাদনা করেছেন অনিমেষ বোস। কী আছে এই তথ্যচিত্রে? ছোটনাগপুর, মানভূম অঞ্চলের বেশকিছু হারিয়ে যেতে বসা নৃত্যশৈলীকে তুলে ধরা হয়েছে। আছে ছৌ নাচ, নাচনি, নাটুয়ার মতো নৃত্যশিল্প। পাশাপাশি হারিয়ে যেতে বসেছে এমন মাছানি, সরহুল, ডেহেং, শিকার প্রভৃতি নৃত্যশৈলীর অনবদ্য কাহিনি-চিত্র।
এই কাজে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তরুণ চিত্রনির্মাতা আমজাদ কাজিকে। বিশেষ করে ডেহেং এবং শিকার নৃত্যশৈলী আর প্রচলিত নেই। ডেহেং নৃত্যশৈলী জানা ছিল নবতিপর আনন্দ কালিন্দীর। তিনি অসুস্থ। তাঁকে সুস্থ করে তোলার পর তিনি এলাকার কিছু যুবককে তালিম দেন। আর তারপর তা তথ্যচিত্রে স্থান পেয়েছে। এমনই বেশকিছু লুপ্তপ্রায় নৃত্যশৈলীর বুনন তৈরি করেছেন তরুণ পরিচালক। এ কেবল তথ্যচিত্র নয়, বরং এক সুবিশাল জনজাতির হারিয়ে যেতে বসা ইতিহাসকে সংরক্ষণ।