করোনা (Corona) সংক্রমনের কারণে গত বছর থেকেই গৃহবন্দী দেশবাসী। এই অতিমারি থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। তাই সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য গত বছরের মার্চ মাস থেকে জীবনযাত্রা বদলে গিয়েছে প্রায় সকলের। বন্ধ রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। চলছে অনলাইন মাধ্যমে পড়াশোনা। তবে এই অনলাইন শিক্ষার (Online Class) গুরুত্ব কতটা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে খুশির খবর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই গোটা দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গিয়েছে দৈনিক সংক্রমণ। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে তাহলে কি এবার চালু করা হবে স্কুল কলেজ? এই প্রসঙ্গে কিছুদিন আগে নবান্ন বৈঠকে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) জানিয়েছিলেন যে পুজোর পর রাজ্য সরকারের স্কুল খোলার চিন্তাভাবনা আছে। যথাসম্ভব সতর্কতার সাথে স্কুল খোলা হতে পারে। এ সিদ্ধান্ত যে নিতান্ত ইতিবাচক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে দীর্ঘ দেড় বছর স্কুল বন্ধ থাকায় প্রথমে স্কুল খুলতে গেলেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। যে সমস্ত ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তা ঠিক হবে কি করে? এই প্রশ্ন এখন সকলেরই মনে।
গত দেড় বছরে কমবেশি অনলাইন মাধ্যমে পড়াশোনা হলেও রাজ্যের কত শতাংশ পড়ুয়া তার সুবিধা উপভোগ করতে পেরেছে তা জানা নেই। প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে ইন্টারনেট পরিষেবা উপলব্ধ নেই তাদের পক্ষে হয়তো অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া স্কুলে পড়া পড়ুয়ারা মোবাইল বা ল্যাপটপের স্ক্রিনের সামনে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা অনলাইন ক্লাস করে আদেও কতটা শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এছাড়া প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে দিয়ে বাড়িতে বসেই হয়েছে পরীক্ষা। এই মূল্যায়নের গুণগতমান কখনই পরীক্ষা হলে বসে পরীক্ষা দেওয়ার সমসাময়িক হতে পারে না। স্কুল কলেজের সিলেবাস হয়তো খাতায়-কলমে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু পড়ুয়ারা কতটা শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। তাই পুজোর পর স্কুল খুললে শিক্ষকদের দেখতে হবে, ছাত্র-ছাত্রীরা কতটুকু লিখতে বা পড়তে পারছে। তারা কোন পর্যায়ে রয়েছে তা বুঝে নিতে হবে। এমন ভাবেই তাদের পড়াতে হবে যে তারা নিজের শ্রেণীর উপযুক্ত লেখাপড়ার ক্ষমতা আয়ত্ত করে।
এছাড়াও এতদিন পড়াশোনা বন্ধ থাকায় স্কুলে অনেকেই আর ফিরে যাবে না। তাই স্কুল খুললে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে প্রতিটি শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে সরকারকে স্লোগান তৈরি করতে হবে এবং ১০০ শতাংশ শিশুকে স্কুলের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে একটি শিশুও না চায়ের দোকানে, মাঠে ঘাটে, কলকারখানায় আটকে যায়। অতিমারী পরিস্থিতিতে অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখাবে যা ভবিষ্যতের জন্য বড়ই ভয়ংকর। শিশুদের স্থান স্কুলে। তাদের উপযুক্ত স্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যেমন সরকারের ঠিক তেমন আমাদেরও। কাজটা কঠিন হলেও সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে সম্ভব করে তুলতে হবে। দারিদ্র্যের সঙ্গে দেশকে লড়াই করতে হলে দরিদ্রের শিশুকে স্কুলে ফেরাতে হবে এবং তাদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। স্কুল পড়ুয়াদের স্কুলের বাইরে রাখা যায় এক প্রকার অপরাধ, এমন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে সমাজে।
এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী। যাঁরা স্কুলের মিড ডে মিল প্রস্তুতির জন্য যুক্ত ছিল তাদের কাজ শুরু করতে হবে স্কুল খোলার একমাস আগে থাকতেই। নিজেদের গ্রামের প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের। তারা খুব সহজেই স্কুলে না যাওয়া শিশুদের সন্ধান করতে পারবে। স্কুলের সঙ্গে সংযোগ রেখে শিশুদের স্কুলমুখী করার কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলগুলিকে কিছু সাম্মানিক দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া যেসব এলাকায় অনেক শিশু স্কুলছুট হয়েছে বা স্থানীয় শিল্প বা বাজারে বহু শিশুশ্রমিক দেখা যাচ্ছে সেখানে প্রশাসনিক দপ্তরগুলিকে সক্রিয় হতে হবে তাদের স্কুলে ফেরানোর জন্য। যদি সরকার এবং সমাজের মানুষ যৌথ প্রচেষ্টা করে তবেই আবারও শিক্ষাব্যবস্থা গতিশীল হবে। অনলাইন ছেড়ে ক্লাসরুমে পড়ুয়াদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাপনা খুব একটা সহজ না হলেও, দেশের ভবিষ্যতের জন্য সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে হবে।