পর্যটন শিল্পের উন্নতি এবং আধুনিকরণের ফলে ধীরে ধীরে বিনষ্টের পথে হাঁটছে সুন্দরবনের (Sundarban) ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। নির্বিচারে চলছে গাছ কাটা এবং যেখানে সেখানে নদীতে বাঁধ নির্মাণ করার কাজ চালানো হচ্ছে। এর ফলে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র। সোশ্যাল মিডিয়াতে সুন্দরবন রক্ষা নিয়ে একাধিক পোস্ট দেখা গেলেও বাস্তবে নির্বিচারে চলছে সুন্দরবন হত্যা। তবে স্রোতের উল্টো দিকে গিয়ে এক ভূগোল শিক্ষক তথা পরিবেশপ্রেমী সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। পেশায় শিক্ষক হলেও স্থানীয়রা তাঁকে "ম্যানগ্রোভ ম্যান" নামে চেনে। ওই ব্যক্তির আসল নাম উমাশংকর মন্ডল (Umashankar Mondal)। তাঁর বাড়ি সুন্দরবন গোসাবা সাতজেলিয়া দ্বীপের চরঘেরিতে। আপনি শুনলে অবাক হবেন যে, সে প্রায় ১২ বছর ধরে সুন্দরবনে সাড়ে ৬ লাখ ম্যানগ্রোভ গাছ রোপন করেছেন।
আগামী ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস। সেই উপলক্ষে ম্যানগ্রোভ ম্যান সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন। তিনি বহু দিন আগে থাকতেই সুন্দরবন অঞ্চলে বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য ম্যানগ্রোভ রোপন এবং তার পরিচর্যা করা শুরু করেছেন। তাঁর "পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটি" নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আছে। এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয়দের সহযোগিতায় তিনি রোপণের আদর্শ মডেল গড়ে তুলেছেন। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর পরিবেশ রক্ষার প্রতি সচেষ্ট হন তিনি। তখন নদীতে ভেসে আসা ম্যানগ্রোভের বীজ সংগ্রহ করে ২২০ জন মানুষকে একত্র করে তিনি বীজ এবং গাছ লাগানোর বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। তারপর থেকেই চলছে সুন্দরবন রক্ষার কাজ।
তিনি বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে নজর গিয়েছেন। আসলে নির্বিচারে সুন্দরবন উন্নয়নের জন্য ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল রাজকাঁকড়া, চিংড়ি, ভেটকি, ঝিনুক, সাপ ইত্যাদি জলজ প্রাণী। তিনি ম্যানগ্রোভ অরণ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাণীদের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে দিচ্ছেন যার ফলে সমৃদ্ধ হচ্ছে জনজাতির অর্থনীতি। তিনি বলেছেন, "ম্যানগ্রোভ লাগানো ও পরিচর্যা দীর্ঘমেয়াদি কাজ। ভাটার সময় কাজে লাগানো যায়। প্রথমে সাড়ে ১০ হেক্টর জায়গায় আমরা গাছ লাগাই। কিন্তু এখন প্রাকৃতিকভাবে তা ৪ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে।" এছাড়া স্থানীয় মানুষদের ম্যানগ্রোভ অরণ্য রোপণে আগ্রহী করে তোলার জন্য তিনি কাজের বিনিময়ে মানুষের হাতে শীতের কম্বল, স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং পুজোর জামা কাপড় তুলে দিয়েছেন। এছাড়া শিশুদের হাতে পড়াশোনার জন্য তিনি তুলে দিয়েছেন বই খাতা।
তবে অনেকেরই একটা প্রশ্ন থাকতেই পারে যে এতকিছু করার জন্য টাকার যোগান কি করে করতে পারেন উমাশঙ্কর মন্ডল? তিনি আসলে ক্রাউড ফান্ডিং এর মাধ্যমে এত বিপুল পরিমান অর্থ জোগাড় করেন। তিনি ছোট ছোট অনুদান সংগ্রহ করে তহবিল গড়ে তুলেছেন। জানা গিয়েছে, আগামী ২৬ জুলাই বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবসে তাঁর ১০ হাজার ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। গাছ রোপন করলে আড়াইশো পরিবারকে তিনি লেবু, চালতা ও সবেদার চারা দেবেন। তাঁর এই মহৎ কাজের প্রশংসা করেছেন সুন্দরবন গবেষক অধ্যাপক জয়ন্ত গৌর। তিনি বলেছেন, "উমাশঙ্করবাবু প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের খাবার, বই খাতা দিয়ে সাহায্য করেন। বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে যেখানে যেখানে দরকার সেখানে তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গাছ লাগান। স্থানীয় মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি আপ্রাণ প্রচেষ্টা করছেন। একক মানুষের এমন প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য।"