বছর কয়েক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'হোক কলরব' আন্দোলন গোটা দেশে রাতারাতি সাড়া ফেলেছিল। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনে পড়ুয়াদের প্রতিরোধ আন্দোলন প্রভাব ফেলেছিল জনমানসে। সঠিক প্রতিবাদ যেকোন 'সুস্থ' গণতন্ত্রের পরিচয়। শাসকের অনৈতিক সিদ্ধান্ত কিংবা কোন ঘটনার নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে পড়ুয়া সমাজ বারবার গর্জে উঠেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতি কতটা গ্রহণযোগ্য সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু শাসকের অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বারবার কিন্তু এই পড়ুয়া সমাজই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন শাসকের নগ্ন রূপ।
সম্প্রতি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা বারবার প্রকাশ্যে এসেছে। কখনও সাসপেনশন, বেতনবন্ধ, বরখাস্ত, আবার কখনও পড়ুয়াদের বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেই চলেছে। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী কিংবা পড়ুয়াদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের 'মনোমালিন্য'-এর ঘটনা গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। বারবার এমন ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে শাসকের ভূমিকা নিয়ে। তাহলে কি শাসকের 'কড়া' মানসিকতাই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী নাকি পড়ুয়াদের 'অন্যায়' আবদার?
বিশ্বভারতীর ঘটনায় দেখা গেছে, অনেক সময় আদালত কর্তৃপক্ষকে 'নরম' মনোভাব দেখাতে বলছে। ধরা যাক সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তিন পড়ুয়ার বহিষ্কারের ঘটনা। শুরু হয় জোরদার আন্দোলন। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে অবস্থান বিক্ষোভ কিংবা ঘেরাও কর্মসূচি। ঘটনার জল গড়ায় আদালত পর্যন্ত। আদালতের নির্দেশে পুণরায় পড়ুয়াদের ক্লাসে ফেরার বয়ান। আদালতের নির্দেশের পরেও ফের আদালত অবমাননার অভিযোগ। সব মিলিয়ে সরগরম বিশ্বভারতী। আবার আরও একটি ঘটনায় আদালতের বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কাছে সুর নরমের নির্দেশ। ১৫ জন শিক্ষকের সাসপেনশন পুনর্বিবেচনার নির্দেশ। এই ঘটনাগুলো কি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের 'উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' এমন প্রশ্ন তুলেছেন একাংশ। শাসকের 'রক্তচক্ষু'-র বিরুদ্ধে গেলেই কি মিলবে এমন শাস্তির কোপ? এমন প্রশ্নও তুলেছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।
গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেরুয়াকরণের অভিযোগ উঠেছে। কখনও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কখনও জেএনইউতে বারবার উঠেছে এমন অভিযোগ। পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে জুটেছে 'দেশদ্রোহী'-র তকমা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে সেসব ঘটনা ভিত্তিহীন। তাহলে কি সুস্থ গণতন্ত্রের স্তম্ভ প্রতিবাদ, অবস্থান বিক্ষোভ, প্রতিরোধ এই শব্দবন্ধ গুলি অচল হতে বসেছে? অন্তত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ঘটনা তো সেদিকেই দৃষ্টি ফেরায়। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী কিংবা শিক্ষার্থীদের বারবার আদালত দৌড় সেকথায় শিলমোহর দেয়। আবার পক্ষান্তরে আদালত অবমাননার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। মনে করা হচ্ছে কর্তৃপক্ষের মাথার উপর অবস্থান করছে বড় শাসক শ্রেণির 'অভয় ছত্র', সুতরাং যা খুশি করার মানসিকতা কি প্রাধান্য পাচ্ছে না? এমন প্রশ্নও তুলছেন সমাজের এক শ্রেণির শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ।
এখন প্রশ্ন উঠেছে এমন মানসিকতা কি কাকতালীয় ঘটনা নাকি এর পেছনে আছে কোন গভীর, সুচতুর দূরভিসন্ধি? একদল বলছেন, গত কয়েক বছরে যেভাবে রাজ্য তথা গোটা দেশে বিরোধী শক্তির কন্ঠরোধের ঘটনা ঘটছে, এ যেন তারই প্রতিফলন। বিভিন্ন সময় 'লঘু পাপে গুরু দণ্ড'-এর মতো ঘটনাও তো আকছার ঘটছে। এমনটা যদি ঘটতেই থাকে, তাহলে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের সংজ্ঞাটাই তো বদলে যাবে। এ তো কম আশঙ্কার নয়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে যদি অধিকার আদায়ের জন্য লড়াইকে বলা হয় দেশদ্রোহিতা, তাহলে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা ঠিক কী বুঝতে অসুবিধা হয় বইকি! বিশ্বভারতীর পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনা সেই বৃহৎ গণতন্ত্রের কাছে প্রশ্ন তুলছে, প্রতিবাদ মানেই কি ধরপাকড় কিংবা কড়া শাস্তি? এর উত্তর মিলবে কী না জানা নেই, তবে আশঙ্কা তো হওয়ারই কথা!