একদিকে দক্ষিণের এক রাজ্য কেরালা দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে ফের ক্ষমতা দখল করেছে সিপিএম, অন্যদিকে উত্তর-পূর্বের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ যা একসময় সিপিএমের দুর্গ ছিল, তার আসন সংখ্যা হয়েছে শূন্য। এক কথায় সিপিএমের ভরাডুবি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চূড়ান্তরূপে প্রত্যাখ্যান করেছে সিপিএমকে। যার ফলস্বরূপ স্বাধীনতার পর এই রাজ্যে প্রথম বিধানসভা গঠিত হল সিপিএম-কংগ্রেস আসন শূন্য রেখে। সিপিএমের এই হারের ফলাফলের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে কার্যত মাছের বাজারে পরিণত হলো বলে মনে করছেন দলের একাংশ। এই হারের পেছনে নানা কারণ দেখেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল, তবে বড় শরিক সিপিএমকে কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়েছে ছোট শরিক দলগুলি। দলের সাম্প্রদায়িক সংহতি ব্যাহত হয়েছে আইএসএফ এর সঙ্গে জোট তৈরি করে সেই অভিযোগ তুলেছেন অন্যান্য শরিক দলগুলো। এমনকি তাদের গুরুত্ব না দিয়ে সিপিএম একা প্রায় একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে আইএসএফকে জোটের আসনে বসিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ফরওয়ার্ড ব্লকসহ অন্যান্য শরিক দল গুলি।
শুধু তাই নয়, আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে আইএসএফকে বাড়তি আসন দিতে গিয়ে অন্যান্য শরিক দলগুলোর আসনে কোপ ফেলেছে সিপিএম। তা কেবল আলিমুদ্দিনের শীর্ষনেতাদের গোয়ার্তুমিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শরিকদলগুলো। প্রথম থেকেই আইএসএফের সঙ্গে জোট নিয়ে সিপিএম দলের ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল একাংশ। আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে জোটের ফলে আরএসপি অভিযোগ করেছে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক তাদের থেকে কেটে তৃণমূলের দিকে ফিরে গেছে। মানুষ এই জোটকে ভালো চোখে নিতে পারেনি।
আরএসপির শক্ত ঘাঁটি ছিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা। গত বিধানসভায় সেখানে তাদের ফল যথেষ্ট ভাল ছিল। কিন্তু গত বিধানসভার তুলনায় এবারে প্রায় ২৭ শতাংশ ভোট কমে গেছে সিপিএমের থেকে। সংখ্যালঘু ভোট কার্যত তৃণমূলের দিকে ফিরে গেছে। মানুষ সিপিএমের ভ্রান্তনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দলের একাংশ।
এই নিয়ে দলের অন্দরে ক্ষোভ প্রথম থেকেই ছিল ফল ঘোষণার দিনই উত্তর দমদমের প্রাক্তন বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমে এসে তিনি অভিযোগ করেছিলেন, "এই হারের দায় আমার বা অন্য কোনও বাম প্রার্থীর নয়। সার্বিকভাবে বামেদের প্রত্যাখ্যান করেছে মানুষ। তাই এই বিপর্যয়ের দায় নিতে হবে দলের শীর্ষনেতৃত্বকে। লোকসভা নির্বাচনে যারা দলকে শূন্য করেছে তাঁরা কোনও দায় নেয়নি। এবার বিধানসভাতেও দল শূন্য হয়েছে। এবার একথা –সেকথা বলে দায়িত্ব এড়ালে চলবে না।" তিনি আরও বলেছিলেন, "দলীয় নেতৃত্বের একাংশ বলে আমরা ভোটে হারজিত নিয়ে চিন্তিত নই। আমরা রাস্তায় আছি। আমাদের দল সংসদীয় রাজনীতিকে গ্রহণ করেছে। সেখানে হারজিতের উপরেই প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করে। যে নেতারা রাস্তায় থাকার কথা বলতেন তাঁদের হাতে একটা ফুটো বাটি ধরিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে জনতা।" দলবিরোধী কথা বলায় তন্ময় ভট্টাচার্যকে দল শোকজ করেছে। যদিও বর্ষীয়ান নেতা তাঁর মন্তব্যে অনড়।
একই কথা শোনা গেল আর বর্ষীয়ান নেতা কান্তি গাঙ্গুলির মুখে। তিনি বলেছেন, "মৌলবাদী শক্তিকে রুখে দিয়ে বাংলার মানুষ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। তা সে যে নেতৃত্বের মাধ্যমেই হোক না কেন। সংযুক্ত মোর্চা মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। গোল গোল কথা না বলে, এর বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান চাই।" তিনি আরও বলেছেন, "সংযুক্ত মোর্চা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে রুখতে পারবে মানুষের এই বিশ্বাস আমরা অর্জন করতে পারিনি। এই বিষয়টা ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব বসে অনুসন্ধান করবেন। সেই অনুসন্ধান যেন অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান হয়। গোল গোল কথা বললে হবে না। তবে আমি ধন্যবাদ জানাই বাংলার মানুষকে, যার নেতৃত্বেই হোক না কেন তাঁরা মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিহত করতে পেরেছেন। রাজ্যবাসী সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।'' কান্তি গাঙ্গুলির গলায়ও একই সুর বলছেন রাজনৈতিক একাংশ। সিপিএমের অন্দরে নীতিগত বিরুদ্ধতা নিয়ে সরব একাংশ, তবে কেউ প্রত্যক্ষে আবার কেউ চুপিসারে!