রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের এই বঞ্চনা সহযোগিতামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপন্থী
কেন্দ্রের রাজ্যকে সাহায্য করতে অনীহা এবং পলাতক মনোভাব নিয়ে কটাক্ষের সুর সব মুখ্যমন্ত্রীর গলায়
যে কোনো দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন্দ্র রাজ্য সংঘাত, এটা গত বছর থেকে ভারতের একটি ভবিতব্যের মতই চলে আসছে। গত বছর থেকে কোভিড মোকাবিলায় একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ির পালা এখনো একইভাবে চলছেই। তার মধ্যেই এসে হাজির করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এবং একই সাথে মানুষের মৃত্যুমিছিল। বাংলার রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে করোনা ভাইরাসকে উপেক্ষা করেই বলা চলে রাজ্যে ২০২১ এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। বিজেপি ভেবেছিল ক্ষমতায় এসে দুটি ইঞ্জিন একসাথে কাজে লাগিয়ে ডবল ইঞ্জিন সরকার চালিয়ে একেবারে 'সোনার বাংলা' তৈরি করে দেবে, আর মানুষ বাহবা দেবে। কিন্তু হল একেবারে উল্টো, চানক্য অমিতের ২০০ আসনের লক্ষ্যমাত্রাতো দূরে থাক মাত্র ৭৭ আসনেই বিজয়রথ থেমে গেল বিজেপির। আর তারপর থেকেই শুরু বিজেপি বনাম তৃণমূল লড়াই, ফোকাস বাংলা।
কিন্তু বাকি রাজ্য সরকারগুলিও বা ছেড়ে কথা বলবে কেন? গত ৩ দিনে অন্তত ৩ জন মুখ্যমন্ত্রী - কেরলের পিনরাই বিজয়ণ, বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেন কেন্দ্রের প্রতি তাঁদের মনোভাব একেবারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাঁরা অভিযোগ জানিয়েছেন, রাজ্যে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার মত জিনিস আসছে না, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে। যদিও সেটা শুধু বিরোধী দলের দ্বারা পরিচালিত রাজ্যের ক্ষেত্রে হচ্ছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছেনা, কারণ বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের সুপ্রিম লিডারের বিরোধিতা করবেন তা কাম্য না। কিন্তু বিরোধী দলের দ্বারা পরিচালিত রাজ্যগুলি গত ৩ দিনে একাধিকবার জানিয়েছে তারা রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের এই ভূমিকায় একদিকে যেমন বীতশ্রদ্ধ তেমনি কেন্দ্রের পলাতকের মত মনোভাবকে একেবারেই মানতে পারছেন না।
যে সব রাজ্যে বিজেপি ব্যতীত অন্যান্য দলের সরকার আছে তাদেরকে এককাট্টা হয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর বার্তা নিয়ে ১২টি রাজ্যকে চিঠি লিখেছেন কেরলের 'বাম' মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন। এর মধ্যে আছে তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, দিল্লি, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, এবং যশ বিপর্যয়ের সময়েও 'কেন্দ্রদরদী' মনোভাব পোষণ করা রাজ্য ওড়িশা। এবারে কি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আবারো একটা যুক্তফ্রন্ট গঠন হবে? কংগ্রেস ও কি এই ফ্রন্টে হবে সামিল, কারণ এই ১২টি রাজ্যের মধ্যে রাজস্থান এবং পাঞ্জাবে কংগ্রেসের সরকার আছে।
কিন্তু কেন্দ্র যতই বলুক না কেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শোলে স্টাইলে কেন্দ্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, "যো ডারতা হ্যায়, ওহ মারতা হ্যায়"। এছাড়াও কেন্দ্রকে তিনি অ্যাডলফ হিটলার এবং জোসেফ স্ট্যালিনের মতোন স্বৈরাচারী নেতাদের সঙ্গে তুলনা করে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের জায়গাটা আরো প্রশস্ত করলেন। তারপরেই এল আলাপন বন্দোপাধ্যায় ইস্যু। নিঃসন্দেহে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অত্যন্ত দক্ষ আইএএস অফিসার। ধীর স্থির মনোভাবের এই ব্যক্তিটি নিশ্চুপে ৩৫ বছর ধরে নিজের কাজ করে গেছেন। কিন্তু নিজের স্বাভাবিক কর্মজীবনের মাত্র ৩ দিন আগে যেন ফাটা বাঁশে পা আটকে যাওয়ার মত অবস্থা হল তাঁর। তাঁকে নিয়ে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে শুরু দ্বন্দ্ব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্তি দিলেন, রাজ্য সরকারের আদেশ ছাড়া এরকম ভাবে কোনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মীকে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য নিয়োগ করা ঠিক নয়। অবসর নিয়ে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার পর উঠে এলো প্রোটোকল ভঙ্গের অভিযোগ। সেই নিয়ে আরও এক বিপত্তি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, যে অফিসারটি প্রোটোকল ভঙ্গ করেন, অর্থাৎ যার ট্র্যাক রেকর্ড খারাপ, তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে কাজ করতে নিয়ে যাওয়াই বা হচ্ছিল কেন? ৬০ বছর বয়সে প্রোটোকলের পাঠ পড়াতে? যাই হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পদক্ষেপকে অযৌক্তিক একটি পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি বাংলার সকলকে এই লড়াই একসাথে লড়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
ভ্যাক্সিনেশন পলিসি --
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারংবার অভিযোগ করে আসছেন কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি অহরহ চেষ্টা করে চলেছে কিভাবে পশ্চিমবঙ্গের সরকারকে বিপাকে ফেলা যায়। বিরোধী নেতাদের মুখে একটাই বুলি, জারি হোক রাষ্ট্রপতি শাসন, রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি 'খুব খারাপ'। এই পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের ব্যাটন নিজের হাতে নিলেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজায়ান। তাঁর চিঠিতে তিনি লিখলেন, "যখন ভারত দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন কেন্দ্রের দায়িত্ব সমস্ত রাজ্যকে ভ্যাকসিনের সঠিক সাপ্লাই দেওয়া। কিন্তু কেন্দ্র তাঁর নিজের কাজ সঠিকভাবে করছে না।" তার সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়া, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাছে ভ্যাকসিনের আলাদা আলাদা দাম। কেন্দ্র সরকার ভ্যাকসিন ১৫০ টাকায় কিনতে পারলেও রাজ্য সরকারকে কোভিশিল্ডের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ৩০০ টাকা করে আর কোভ্যাকসিনের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ৬০০ টাকা।
রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের এই বঞ্চনার অভিযোগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যদিকে, ২৯ মে তাঁর লেখা চিঠিতে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাটিকে অভূতপূর্ব বলে উল্লেখ করে সকলকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার বার্তা দিলেন। এছাড়াও তিনি লিখলেন, এই মুহূর্তে কেন্দ্রের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত রাজ্য সরকারের কাছে সঠিক পরিমাণে ভ্যাকসিন পাঠানো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন লিখেছেন, "ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম এরকম ঘটনা ঘটলো যেখানে রাজ্য সরকারকে বলা হচ্ছে তাঁদের নিজেদের ভ্যাকসিন নিজেদের কিনতে হবে। এরকম একটি কঠিন পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া এরকম একটি সিদ্ধান্ত সহযোগিতামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপন্থী।"
সিবিআই এর দ্বিচারিতা --
কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতীয় জনতা পার্টি কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা যেমন - সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, এনআইএ এবং তাদের আইটি ডিপার্টমেন্টকে বহুল ব্যবহার করে আসছে বিরোধী দল দ্বারা পরিচালিত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে। অন্তত পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি এবং তৃণমূল নেতাদের ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের আচরণ অত্যন্ত দ্বিচারিক এবং নারদ মামলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই দ্বিচারিতা বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট। তবে রাজ্যের এই সমস্ত অভিযোগকে কেন্দ্র সরকার গুরুত্ব দিতে নারাজ। বরং তাঁরা সিবিআইকে আরো ব্যবহার করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ছোট থেকে ছোট মামলার তদন্ত করতেও পিছপা হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বিরোধিতা করে সমস্যা আছে, এই কথাটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা ওয়াইএসআর কংগ্রেসের নেতা জগনমোহন রেড্ডি সরাসরি মোদির সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন। ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোভিড নিয়ে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীদের কথা শোনেন না, তখন জগনমোহন রেড্ডি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদির সমর্থন করেছিলেন। এছাড়াও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গতি প্রকৃতি একটু অন্যরকম। যেহেতু তিনি কেন্দ্রীয় সাপোর্ট পাচ্ছেন, তাই তিনি সরাসরি বিরোধিতা করেন না। প্রয়োজনের সময় তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পিনারাই বিজয়নের কাছ থেকে সাহায্য নিলেও তাদের প্রয়োজনে সাহায্য অন্তত কেজরিওয়ালের কাছ থেকে আশা করাটা ভুল। তবে যাই হোক, বর্তমানে কেন্দ্র এবং রাজ্যের এই দড়ি টানাটানি খেলায় যেন সাধারণ মানুষের স্বার্থে আঘাত না লাগে, সেটাই চাইছেন এখন সকলে।