সেই ১৯৬৮ সালে ইউরো জয়, তারপরে আবার ২০২১, এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য ইউরো কাপ এলো রোমে। বিশ্বকাপ ৪টি এলেও ইউরো কাপ ছিল ওই একটিই। কিন্তু ২০২০ এর ইউরো হয়ত অন্যকিছু ভেবে রেখেছিল আজ্জুরিদের জন্য। দীর্ঘ ৫৩ বছরের খরা কাটিয়ে চেলিনি ও রবার্তো মানচিনির হাত ধরে ইউরোপের নতুন চ্যাম্পিয়ন হলো ইতালি। আর এই জয়ের মূল কান্ডারী হয়ে রইলেন বছর ২২ এর ৬ ফুট ৫ ইঞ্চির দীর্ঘদেহী ইটালিয়ান গোলরক্ষক জিয়ানলুইগী দনারুম্মা, যার বাঁদিকে একটি ঝাঁপ শেষ করে দিল ইংল্যান্ডের দীর্ঘ ৫৫ বছরের সব আশা। এই ইউরো কাপের রাস্তাটা খুব একটা সহজ ছিলনা ইতালির কাছে। কিন্তু চেলিনির দলের ডিকশনারিতে হার শব্দটাই যেন নেই। ইউরো ২০২০ এর প্রথম ম্যাচ থেকেই নিজেদেরকে বেস্ট প্রমাণ করতে শুরু করে ইতালি। যে দলটা ২০১৮ এর ফিফা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই পর্যন্ত করতে পারেনি, আজকে সেই দলটাই ইউরোপ সেরা খেতাব ঘরে তুলল।
গ্রুপ এ থেকে যাত্রা শুরু, ২০২০ ইউরো কাপে প্রথম থেকেই কঠিন গ্রুপে শুরু করে ইতালি। সামনে গ্যারেথ বেলের ওয়েলস, শাকা ও শাকিরির সুইজারল্যান্ড এবং টার্কি। তিনটির মধ্যে তিনটি ম্যাচ জিতেই সরাসরি রাউন্ড অফ সিক্সটিনে আজ্জুরিরা। সেখানে আগে অস্ট্রিয়া, তারপর কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামকে হারিয়ে সোজা সেমিফাইনালে রবার্তো মানচিনির ইতালি। সামনে প্রতিপক্ষ চরম রাশভারী স্পেন। আলভারো মোরাতা, রামোস, বাস্কেটসদের চরম আক্রমনের সামনেও বুক চিতিয়ে লড়লেন বনুচী, চেলিনিরা। পেনাল্টি শুটঅাউটে এলো বহুপ্রতিক্ষিত জয়। সৌজন্যে সেই দনারুম্মা। আলভারো মোরাতার শেষ শট আটকে দিয়ে নিজের দলকে ফাইনালে নিয়ে চলে গেলেন এই দীর্ঘকায় গোলরক্ষক।
অন্যদিকে ইংল্যান্ডের জার্নিটাও ছিল লক্ষণীয়। ডেনমার্ককে এক্সট্রা টাইমে গোল দিয়ে ম্যাচ জিতে নেয় গ্যারেথ সাউথগেট ও হ্যারি কেনের ইংল্যান্ড। আর সেই দিন ডেনমার্কের স্বপ্নের দৌড়ের কফিনে শেষ পেরেক পোতার কাজটি সুসম্পন্ন করেন ব্রিটিশ অধিনায়ক হ্যারি কেন। যদিও এই পেনাল্টি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। রহিম স্টার্লিং এর আলতো টাচে পড়ে যাওয়া, পেনাল্টির সময় ড্যানিশ গোলকিপারের চোখে লেজার লাইট, মাঠে দুটি বল চলে আসার পরেও খেলা চালিয়ে যাওয়া, রেফারির জঘন্য ম্যাচ পরিচালনা, সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডের সেমিফাইনাল যে খুব পরিষ্কার ছিল তা বলার উপায় নেই। কিন্তু দিনের শেষে শেষ হাসি হাসলেন হ্যারি কেনরা।
কাট টু ইউরো ২০২০ ফাইনাল ম্যাচ। ফাইনালে ইংল্যান্ডের হোম গ্রাউন্ডে মুখোমুখি ইউরো জয়ের জন্য মরিয়া দুই দল - ইটালি ও ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের রাজ পরিবার আগেই জানিয়েছিল, এবারে যদি ইংল্যান্ড জিতে যায় তাহলে সাম্মানিক নাইট হুড পাবেন ইংলিশ কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। সেটার একটা চাপ ছিলই। গ্যালারিতে বসে ইংল্যান্ডকে সমর্থন করতে এসেছিলেন বর্ষিয়ান ফুটবল তারকা ওয়েন রুনি, ডেভিড বেকহ্যাম, হলিউডের অন্যতম সেরা তারকা টম ক্রুজ, ইংল্যান্ড এর প্রেসিডেন্ট বরিস জনসন, এবং ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের সদস্যরা। হোম ক্রাউডের প্রবল সাপোর্টে ওয়েম্বলি ছিল কার্যত লালে লাল। হ্যারি কেন, রহিম স্টারলিংরা আগে থেকেই বেশ কিছুটা অ্যাডভান্টেজ পেয়ে বসেই ছিলেন।
খেলা শুরু হলো। ম্যাচের মাত্র ২ মিনিটের মাথায় একটা কর্নার, ইতালির পক্ষে। কিন্তু গোল তো দূর কি বাত সেই কর্নারের কাউন্টার আক্রমণে একটা গোল হজম করে বসলেন আজ্জুরিরা। দনারুম্মার গা ঘেঁষে বল জালে জড়িয়ে দিতে ভুল করলেন না বার্থডে বয় লুক শ। ট্রিপিয়ারের ভাসানো পাস সরাসরি গোলে কনভার্ট করতে কোনো ভুল করলেন না এই ব্রিটিশ ফরওয়ার্ড। তারপর থেকেই জ্বলে উঠলো হ্যারি কেনের ইংল্যান্ড। আরো কয়েকটি এটেম্পট হলো, কিন্তু আর কোনো ভুল করলেন না দনারুম্মা। প্রথমার্ধে ইংল্যান্ড এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে লাগাতার আক্রমণে উঠতে শুরু করলো আজ্জুরিরা। ৬৭ মিনিটে সেই বহু প্রতীক্ষিত গোলটি এলো, আর করলেন সেই লিওনার্দো বোনুচি। একটি কর্নার কিক তিন তিনবার আটকানোর পরেও বনুচির তৃতীয় ফিরতি শট হ্যারি কেনকে টপকে চলে যায় গোলে। খেলায় ফিরে এলো ইতালি। স্কোরবোর্ডে তখন ১-১। নতুন প্রাণ ফিরে ফেলেন সংখ্যায় কম আজ্জুরি সমর্থকরা। এই ইকুয়ালাইজার এনে দিয়ে ব্রিটিশ ডিফেন্সকে একেবারে ফালাফালা করে দিলেন বনুচি। তারপরেও একগুচ্ছ সুযোগ এলো দুই দলের কাছেই কিন্তু একটা শটও গোলমুখ খুলতে অপারগ। এখানেই প্রশংসার যোগ্য দুই দলের গোলরক্ষক, একদিকে যেমন দনারুম্মা বুনো ওল তেমনি পিকফোর্ড বাঘা তেতুঁল। দুজনেই একচুলও জমি ছাড়তে নারাজ।
৯০+৩০(এক্সট্রা টাইম) মোট ১২০ মিনিটের খেলা শেষ। অতএব, ফয়সালা হবে সেই টাইব্রেকারে, যেখানে ফকির রাজা আর রাজা ফকির হয়ে যেতে পারে। বাকি ১০ জনের থেকেও বেশি ফোকাসে দুই দলের গোলরক্ষকরা। একদিকে হলুদ জার্সিতে আজ্জুরী গোলকিপার দনারুম্মা, আর অন্যদিকে সবুজ পোশাকে ইংলিশ গোলকিপার জর্ডান পিকফোর্ড। পেনাল্টি শুট আউটে ইতালির দ্বিতীয় শট অর্থাৎ বেলোত্তির শটটি প্রতিহত হওয়ার পরে ইংরেজ সমর্থকদের অনেকে ভেবেই রেখেছিলেন জিতছে ইংল্যান্ড। ইউরো থাকবে ব্রিটেনে। কিন্তু ইংল্যান্ডের নিয়তি ছিল অন্যরকম। পরপর ৩টি শট বাঁচিয়ে ইতিহাস রচনা করলেন জিয়ানলুইগী দনারুম্মা। ইংল্যান্ডের ৫ম শটটি হাত দিয়ে প্রতিহত করে নতুন রেকর্ড গড়লেন এই ইতালিয় গোলকিপার। এতদিন অবধি ইউরো কাপে কেউ ব্যাক টু ব্যাক দুটো পেনাল্টি শুটঅাউট জয় করেনি। কিন্তু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন জিয়ানলুইগী দনারুম্মা। আর সেই কারণেই তিনিই নির্বাচিত হলেন ম্যান অফ দা টুর্নামেন্ট। আর নীল পোশাকের আজ্জুরীদের হাতে এলো সেই ট্রফি, যার জন্য দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে অপেক্ষা করছিল তামাম ইতালিয় সমর্থকরা।
ইতালি জিতলেও আদতে কিন্তু জিতলো ইউরোপীয় ফুটবল। সত্যিকারের ফাইনালের মতো একটি ফাইনাল ম্যাচ শান্তভাবে হাসিমুখে পরিচালনা করলেন বিশ্বের ধনীতম রেফারি ডাচ রেফারি জর্ন কুইপার্স। স্পোর্টসম্যান স্পিরিট দেখালো ইতালি এবং ইংল্যান্ড। ক্রাচে করে হলেও দলের জয়ের মোমেন্টে অংশ নিতে এলেন বেলজিয়াম ম্যাচে পায়ে চোট লাগা ডিফেন্ডার লিওনার্দো স্পিনাজলা। আবার কোথাও একটু চোখের জল, খারাপ লাগার মুহূর্ত, ইংরেজ সমর্থকদের হার্টব্রেক, করোনা বিদ্ধস্ত ইতালির সমর্থকদের নিজের দেশের সমর্থনে গলা ফাটানো, সবকিছুকে সঙ্গী করে বয়সকে এক তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে ইউরো কাপ হাতে তুলে নিলেন ইতালীয় অধিনায়ক বছর ৩৬ এর জর্জিও চেল্লিনি। গ্যালারিতে দীর্ঘ ৫৩ বছর পরে আবারো বেজে উঠলো ইতালি ওয়ানস মোর। কারণ, দীর্ঘ অপেক্ষার পরে 'ইউরো এলো রোমে'।