১৯৯৯ সালে ২৭ আগস্ট, উত্তর চব্বিশ পরগনার দত্তপুকুরে জন্ম হয় ছেলেটির। দত্তপুকুর নিবাধই হাই স্কুল থেকে পড়াশুনা করে, ব্যাচেলর ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন। আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত পরিবারের মত 'চাকরিই শেষ কথা', এমন মনোভাব তাঁর বা তাঁর পরিবারের ছিল না। নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতার মর্যাদা ছিল তাঁর আপনজনের কাছে। সেই কারণেই তিনি হয়ে উঠলেন, বাংলার অন্যতম কনিষ্ঠ জনপ্রিয় ইউটিউবার, 'বোকা চন্দ্র', থুড়ি রাহুল দে।
টিম পরিদর্শককে রাহুল জানান, ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর চাকরি করার ইচ্ছে ছিল না। বাড়ির মানুষ সেই তুলনায় কড়া ধাতের না হলেও, যেহেতু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছিলেন, তাই স্বভাবতই অন্যান্য পরিবারের মত ইচ্ছে ছিল, ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়াক। তাঁর বাবার একটি ছোট ব্যবসা ছিল। তাই তিনি চেয়েছিলেন, সন্তান যদি চাকরি করেন, তাহলে ভবিষ্যতের চিন্তা থাকবেনা। কিন্তু সন্তানের চাওয়ার মূল্যও ছিল তাঁর কাছে। রাহুল স্বাধীনতা পেয়েছিলেন নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নেওয়ার। উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে, কলেজে ওঠার সময় তাঁর কয়েক বছর আগে খোলা ইউটিউব চ্যানেলটি ইতিমধ্যে হয়ে উঠেছিল কুড়ি হাজারের বেশি মানুষের আশ্রয়। এই ছিল তাঁর এগিয়ে যাওয়ার মূল মন্ত্র। সেই প্রথম রাহুলের মনে হয়, নতুন কিছু করে এগোনো যাক।
চাকরির ইচ্ছে না থাকায়, মাধ্যমিকের পর বেছে নেন আর্টস। থিয়েটার করা শুরু করেন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন। সেই সফর স্থায়ী হয় মাধ্যমিক পর্যন্ত। তখন সোশ্যাল মিডিয়া বা ইউটিউব সম্পর্কে অবগত ছিলেন না রাহুল। একাদশ শ্রেণীতে পড়াকালীন জিও নেটওয়ার্কের যুগ আসে। এই প্রথম রাহুলের প্রবেশ ঘটে আন্তর্জালক বিশ্বে। পরিচয় ঘটে ইউটিউব সম্পর্কে। ছোট থেকে নৃত্য প্রেমী রাহুল, নিজের মত করে তাঁর নাচের ভিডিও ইউটিউবে চ্যানেল খুলে আপলোড করতে থাকেন। 'আমি নাচটা ছোটবেলা থেকেই করতে ভালোবাসি। এখনও যখন ইচ্ছা হয়, তখনই করি। তার মধ্যে যদিও খুব কম ভিডিও আমি পোস্ট করি চ্যানেলে। ইচ্ছা আছে যে ভবিষ্যতে আরও ভিডিও আপলোড করবো।' প্রথম দিকে তাঁর নাচের ভিডিও আপলোড করা হত খানিক খেলার ছলেই। টিম পরিদর্শককে জানান, 'একটার পর একটা নিজের মত ড্যান্স ভিডিও আপলোড করতে থাকি। সেই মুহূর্তে কোনো এক্সপেক্টেশনই আমার ছিলনা।'
বেশ কিছু বছর আগে, রাহুল নেট দুনিয়ায় পরিচিত হয়ে ওঠেন, 'বোকা চন্দ্র' হিসেবে। এই ধরনের নাম নির্বাচনের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে, রাহুল পরিদর্শককে জানান, নাম নির্বাচন হয়েছিল একেবারেই খামখেয়ালী ভাবে। 'প্রথম বছর ড্যান্স ভিডিও আপলোড করার পর পাঁচশো মত সাবস্ক্রাইবার হয়, তারপর আমার একটু নলেজ আসা শুরু করে যে কনটেন্ট ক্রিয়েটিং বলে কোনো মাধ্যম হয় মত প্রকাশের। সেই মুহূর্তে চ্যানেলের নাম নিয়ে ভাবিনি অত। তখন এক্সপেকটেশনও ছিলনা চ্যানেল গ্রো করার ব্যাপারে বা মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার ব্যাপারে। আমি কেবল কনটেন্ট ক্রিয়েটিংয়ে মন দি, হঠাৎ বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার ছলে নামটার উৎপত্তি, তারপর সেই নাম দিয়েই শুরু হয় পথ চলা।'
তিনি যে ধরনের ভিডিও বানান, তাঁর ভিত কিভাবে প্রতিষ্ঠা হয়? সব কি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকেন্দ্রিক? পরিদর্শককে রাহুল জানান, তিনি তাঁর কন্টেন্টের রসদ সমাজ থেকেই গ্রহণ করেন। বিভিন্ন মানুষের কথোপকথন অথবা খবরের চ্যানেলে দেখানো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক হাল হকিকত, আমাদের সিস্টেমের অবস্থা, সব মিলিয়ে একটি কৌতুকের বাতাবরণ তৈরি করে মানুষের উপভোগ করার মত উপস্থাপনা করার চেষ্টা করেন।
বাংলার প্রায় সকল ইউটিউবারের সঙ্গেই ভালো মতন সখ্য যাপন করেন 'বোকাচন্দ্র'। পছন্দের তালিকায় নির্দিষ্ট কাউকে বাছাই করা তাই, তাঁর পক্ষে জটিল। তিনি টিম পরিদর্শককে জানান, 'আমার পছন্দের তালিকায় অন্তত কুড়ি তিরিশটা চ্যানেল আছে যাদের আমি দেখি। নিয়মিত না হলেও দেখি। বাংলা কমিউনিটি সদ্যজাত বাচ্চা ছিল, এখন আস্তে আস্তে পরিণত হচ্ছে। এমনও আছে এক হাজার দু হাজার সাবস্ক্রাইবার থাকা ইউটিউবাররা এত সুন্দর কনটেন্ট বানাচ্ছেন যে লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবার থাকা ক্রিয়েটাররা তাঁদের দেখে শিখছেন। আমিও সবার থেকে শেখার চেষ্টা করে যাই প্রতিনিয়ত।'
এখনকার যুবোগোষ্ঠির রাজনৈতিক সচেতনতা যুগের সঙ্গে বেশ পরিণত হয়েছে। কম বেশি সকলেই প্রায় চান, রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে। রাহুলকেও তাঁর ভিডিওয় দেখা যায়, রাজনৈতিক তরজা নিয়ে প্রায়শই তিনি তৎপর হন। যদিও তিনি পলিটিক্স নিয়ে উৎসাহী, কিন্তু নিজে কখনও রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন কিনা, সে ব্যাপারে এখনও ভাবেননি।
রাহুল মনে করেন, এখন ফলোয়ার্স বাড়ানো বা মানুষের কাছে পরিচিত মুখ হওয়া এই মুহূর্তে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু ক্রিয়েটাররা কোন কাজ করে ফলোয়ার্স বাড়াচ্ছেন, বা মানুষ তাঁদের কি জন্য চিনছেন, এগুলো একজন ইউটিউবারের বোঝা উচিৎ, জানা উচিত। একজন দায়িত্ববান ইউটিউবার হওয়ার দরুন তাই তিনি খেয়াল রাখেন, তাঁর কন্টেন্ট থেকে মানুষ কিছু শিখুক বা না শিখুক, কিন্তু যেন খারাপ ভাবে কেউ প্রভাবিত না হন। তাঁর বয়ানে, 'আমি হয়তো বয়সে ছোট অনেক ইউটিউবারের থেকে, এমন অনেক আমার থেকে বড় ইউটিউবার আছেন যাঁরা কিছু না ভেবে, না বুঝে এমন কোন কথা বলে দেন যা মানুষের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। অন্তত দশটা মানুষও যদি আমাকে ফলো করেন, আমার একটা দায়িত্ববোধ চলে আসে আমি তাদেরকে কি পরিবেশনা করছি তার ওপর।'
আমরা সবাই জানি, রাহুল মূলত বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর ইউটিউব চ্যানেল 'বোকা চন্দ্র' এর জন্য। কিন্তু এখন সেই নামই পরিবর্তন করে, তিনি স্বনামেই চ্যানেলের ভার সামলাচ্ছেন। টিম পরিদর্শক এই আকস্মিক নাম বদলের কারণ জানতে চাওয়ায়, তিনি জানান যে এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ নেই। এর মধ্যে তিনি তাঁর কন্টেন্টে অনেক পরিবর্তন এনেছেন শেষ কিছু বছরে। আরও আনবেন, এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ করবেন যা বাংলা ইউটিউব কমিউনিটিকে নতুনের ছোঁয়া দেবে এমন ভাবনার প্রেক্ষিতে তিনি আশাবাদী। প্রধানত প্যান্ডামিকের সময়ে, তাঁর কন্টেন্টে নতুনত্ব আসে। তারপর থেকে তিনি তাঁর ভিডিও নিয়ে বিভিন্ন ফিডব্যাক পেতে থাকেন বড়দের কাছ থেকে বা অন্যান্য ইউটিউবারদের কাছ থেকে। তাঁর মতে, সেই ফিডব্যাক গুলির কমন কথা ছিল, চ্যানেলের নামের জন্য সিরিয়াস কন্টেন্টও সকল মানুষের কাছে সমান গুরুত্ব বহন করতে পারছে না। 'যখন আমি বৃদ্ধাশ্রমের এগেনস্টে ভিডিও বানাই বা প্যান্ডামিকের সময় মানুষের মেন্টাল হেলথ নিয়ে ভিডিও বানাই, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন আমার বয়সটা যেহেতু তুলনামূলক কম এবং চ্যানেলের নাম "বোকা চন্দ্র", তাই বার্তাগুলো হয়তো সেরকম গুরুতর নয়। তাই তাঁরা সেভাবে সিরিয়াসলি গ্রহণ করেননি ভিডিওগুলো। মজার ছলেই গ্রহণ করেছিলেন। তখন আমার মনে হয় নামটা কোথাও গিয়ে সব স্তরের মানুষের কাছে সামাজিক বার্তাগুলির সমান মূল্য পরিবেশনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। নামের জন্য সিরিয়াস ইস্যুও মজার ছলেই পরিবেশিত হচ্ছে। তাই তখন মনে হল চ্যানেলের নাম পরিবর্তন করতে হবে।'
বর্তমানে ইউটিউব জুড়ে কনটেন্ট ক্রিয়েটরে ভরে গেছে। 'এখন ঘুম থেকে উঠলাম' থেকে শুরু করে 'রাত হয়েছে ঘুমাতে যাচ্ছি'... এমন ভ্লগও নেটিজেনরা হজম করছেন, আর তাতে দেদার ভিউজ। শুধু তাই নয়, সিনেমা বা সিরিয়ালের ছোট থেকে বড়ো সমস্ত তারকারাও চ্যানেল খুলতেই মাত্র কয়েক দিনে রোজগার শুরু করছেন ভিডিও থেকে। প্রতিযোগিতা আরও জটিলতর হয়ে উঠছে। যাঁরা অনেক লড়াই করে আজ পরিচিত হয়েছেন, তাঁদেরকে টেক্কা দিয়ে দিচ্ছেন নতুনরা। এই বিষয়ে নিয়ে রাহুল জনান, 'দেখো এই মুহূর্তে সব ধরনের ভিডিওর অডিয়েন্স আমাদের কাছে আছে। মানুষের কাছে নানা রকম বিকল্প আছে তিনি কিরকম ভিডিও দেখতে চান, তিনি বাংলার কোনও না কোনও চ্যানেলে সেইরকম ভিডিও দেখতে পাবেন নিজের ইচ্ছেমত। কিন্তু আমার মনে হয় হিন্দি কমিউনিটির থেকে আমরা হয়তো অনেকটাই পিছিয়ে, কারণ আমরা মানুষকে নতুন কিছু দেখাতে পারছি না, তাই মানুষ সেভাবে দেখছেনও না। ম্যাক্সিমাম ক্রিয়েটার ট্রেন্ডিং টপিকে ভিডিও বানয়, কিন্তু যারা নতুন কিছু করার চেষ্টা করে তারা তুলনামূলকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তখন তাদের মনে হয় ট্রেন্ডিং ভিডিও বানানোই শ্রেয়। তবে আমার যেহেতু নিজের ভ্লগিং চ্যানেল আছে, সেক্ষেত্রে মনে হয় আমি যেহেতু নিজে স্ক্রিপ্ট লিখে ভিডিও তৈরি, সেই তুলনায় যেরকম ভ্লগ আমরা দেখি আশেপাশে, সেখানে অপেক্ষাকৃত কম এফোর্ট দিতে হয়।'
কনিষ্ঠ এই ইউটিউবারের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে চোখ রাখলে, প্রায়ই তাঁকে প্রকৃতির কোলে মুহুর্ত যাপন করতে দেখা যায় লকডাউনের পর থেকে দুবছর তিনি চুটিয়ে ঘুরেছেন। আগামীতেও প্রচুর ঘোরার পরিকল্পনা আছে তাঁর। ট্রাভেল ভ্লগ বানাতে তিনি দারুন উপভোগ করেন। সাক্ষী রাখেন অনুগামীদের। বলা বাহুল্য, এই সময়ের 'সেনসেশন' রাহুল দের সফরসঙ্গী হতে পেরে তাঁরাও যারপরনাই খুশি হন। রাহুল পরিদর্শককে জানান, 'যে জায়গাগুলো আমি ঘুরব আগামীতে, চেষ্টা করব আমার দর্শকদের কাছে তার ইতিহাস তুলে ধরার।' খাদ্য রসিক রাহুলের, পছন্দের যেকোনো একটি খাবার নির্বাচন করাও বেজায় জটিল। তাও অনেক ভেবে চিন্তে, পছন্দের খাবারের তালিকায় 'মটন'কে তিনি জয়ী করেন।
রাহুল 'স্যাটিসফায়েড' তাঁর এই আন্তর্জালক জীবনে। যে শখ পূরণ তাঁর চাকরি করে করতে গেলেও বছরের পর বছর লেগে যেত, সেই শখ তাঁর এখন পূরণ হচ্ছে ভরপুর ভাবে। জীবনের প্রতি তাই তাঁর কৃতজ্ঞতার সুর ধ্বনিত হল।