সালটা ২০০৭ কি ২০০৮, পড়াশুনার প্রতি সেই অর্থে আগ্রহ ছিল না। অভিনয়ের প্রতিও যে খুব টান ছিল, এমনটা নয়। তবে পারিবারিক অস্বচ্ছলতা তাঁকে ভাবিয়ে তোলে আগামীর কথা। মায়ের পাশে দাঁড়ানো, তথা পরিবারের সম্বল হয়ে ওঠার জন্য, দীর্ঘ চেষ্টার পর সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীনই বেছে নেন অভিনয়ের পথ। শিশু শিল্পী হিসেবে হাতে খড়ি। একশো টাকা বা কখনও কখনও বিনামূল্যেও করতে হত কাজ! ২০০৮ থেকে ২০১৪ এর সফর, মোটেই সহজ ছিল না অভিনেতা সায়ক চক্রবর্তীর (Sayak Chakraborty) জীবনে। ২০১৪ এর পর তিনি হয়ে ওঠেন, টলিপাড়ার পরিচিত মুখ।
সোনারপুর বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চমধ্যমিক পাশ করে, মাস কমিউনিকেশন সায়ক নিয়ে ভর্তি হন সিকিম মনিপাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র হিসেবে কেমন ছিলেন সায়ক? টিম 'পরিদর্শক' এর করা প্রশ্নের উত্তরে অভিনেতার অকপট স্বীকারোক্তি, "একদমই ভালো ছাত্র নই আমি, পড়াশুনা একদমই পছন্দ নয়, পারতামও না..।"
ইতিমধ্যেই প্রায় কুড়িটিরও বেশি ধারাবাহিকে তিনি অভিনয় করছেন। রিয়েল লাইফের সায়কের সঙ্গে কী মিল পেয়েছেন রিল লাইফের চরিত্রে? অভিনেতা জানান, বাস্তবের সায়কের সঙ্গে তাঁর অভিনীত কোনো চরিত্রের মিল পাননি। কিন্তু 'করুণাময়ী রানী রাসমণি', 'মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য', 'আমি সিরাজের বেগম' এ তাঁর চরিত্রগুলি, তাঁর কাছে বিশেষ পছন্দের। এই চরিত্রগুলির জন্য তাঁকে করতে হয়েছে অনেক পরিশ্রম। চেনা ছকের বাইরে, পৌরাণিক বা কাল্পনিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্মিত এমন 'ভিন্ন' চরিত্রে অভিনয় করতে পেরে, অভিনেতা যারপরনাই আপ্লুত।
বাঙালির ঘরে ঘরে তিনি, 'মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য' এর 'কৃষ্ণ' হিসেবে বহুল সমাদর পান। সায়ক থেকে 'কৃষ্ণ' হয়ে ওঠার জার্নির কথা বলতে গিয়ে পরিদর্শককে তিনি বলেন, টানা সাতদিন শুটিং ফ্লোরে না গেলে তাঁর ভেতরে হাহাকার করত। যেই মুহুর্তে তিনি ফ্লোরে পা রাখতেন, অদ্ভুত শান্তি এবং তৃপ্তিতে ভরে উঠত তাঁর মন। অভিনেতার আবেগতাড়িত কণ্ঠে শোনা যায়, "মহাপ্রভুতে মেক আপ থেকে শুরু করে ড্রেস, পাগড়ি, চুল, সবকিছু আমি নিজে করতাম। প্রথমদিকে মেক আপ আর্টিস্টরা করে দিলেও, শেষ দিকে আমিই এক্সপার্ট হয়ে উঠি। নিজের মাধ্যমে এমন ধরনের এক শক্তিশালী চরিত্রকে জন্ম দেওয়া, ডায়লগ ডেলিভারি, সবটা করে খুব তৃপ্তি লাগত।"
'মন ফাগুন' ধারাবাহিকে সম্প্রতি এক বিশেষ চরিত্রে প্রবেশ ঘটেছিল সায়কের। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? উচ্ছ্বসিত হয়ে সায়ক বলেন, "মন ফাগুন'এ অভিনয় করে দারুন অভিজ্ঞতা, সকলে খুব ভালো। শনের সঙ্গে আগেও 'আমি সিরাজের বেগম' এ কাজ করেছি। ফ্লোরে গিয়ে কখনও নিজেকে গেস্ট গেস্ট মনেই হয়নি। খুবই বন্ধুবৎসল সকলে।"
সায়ক চক্রবর্তী শুধু একজন সফল অভিনেতাই নন, একজন সফল ইউটিউবারও। গত ১৭ ই জুন, তাঁর ইউটিউব চ্যানেল 'লেটস স্টার্ট ' (Let's Start) এক বছরে পা দিল। শুটিংয়ের সঙ্গে সামলাতে হয়, ইউটিউব ভিডিওর প্রি এবং পোস্ট প্রোডাকশনের দায়িত্বও। বলাবাহুল্য তা খুবই ঝক্কির! কিভাবে সব দিকে সামঞ্জস্য রাখেন সায়ক? 'পরিদর্শক'কে অভিনেতা জানান, "আমার শুটিংয়ে প্যাক আপ হয় রাত ন'টার পর। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিয়ে রাত এগারোটার পর বসি ভিডিও এডিটিং নিয়ে। যদিও আমার বেশি এডিট করতে লাগে না। কারণ আমার দু লাখ পচাত্তর হাজারের পরিবার আমায় জানে, যে আমার কত পরিশ্রম থাকে। একটার সঙ্গে একটা ভিডিও জুড়ে দিলে তাঁরা সাদরে গ্রহণ করেন। পরিবার বলছি এই কারণে, কারণ বাড়িতে কোনও রান্না হলে, সবাই তৃপ্তি করে খেয়ে নেয় সে রান্না যেমনই হোক। আমার সঙ্গেও আমার দর্শকদের সেরকম পারিবারিক সম্পর্ক।"
সোশ্যাল মিডিয়ার পাতা ওল্টালেই পরিবারের সঙ্গে মুহুর্ত যাপনে মাততে দেখা যায় সায়ককে। রিল লাইফের সঙ্গে, রিয়েল লাইফেও সমান ভাবে সময় দিতে কি পারেন তিনি? অভিনেতার দাবি, শুটিংয়ের বাইরে ভ্লগ বানানো আছে যেমন , তেমন আছে পরিবার। পরিবার ছাড়া ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউবের বিজ্ঞাপনের জন্যও তাঁকে সময় দিতে হয়। কিন্তু পরিবারই তাঁর কাছে আসল। সবকিছু নিয়েও দিনের শেষে এই পরিবারের জন্য তিনি নিজেকে একা ভাবেন না। "দিনের শেষে আমার পরিবার থাকে। যাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে আমার ভালো লাগে। মায়ের সঙ্গে থাকতে, বেরোতে আমি খুব আনন্দ পাই। পরিবার আছে বলেই আমার জীবনে অবসাদের আবির্ভাব ঘটেনি। তাই আমি খুব ভালো আছি।" পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা সুর ধ্বনিত হয় সায়কের কণ্ঠে।
শিবপ্রসাদ মুখার্জী (Shiboprosad Mukherjee) এবং নন্দিতা রায়ের (Nandita Roy) ছবি, 'বেলাশুরু' তেও একটি বিশেষ চরিত্রে সায়কের উপস্থিতি নজর কাড়ে। চরিত্রের উপস্থাপন স্বল্প হলেও, তাঁর ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ন ছিলনা। 'বেলাশুরু'র মত বহুল সমাদৃত ছবিতে সায়ক ছবির অংশ হতে পেরে তিনি বেশ খুশি। "সিনেমাটা খুব ভালো হয়েছে, আপনারা প্লিজ সকলে সিনেমাটা দেখবেন। এছাড়াও আমায় যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁরা আমায় সিরিয়ালেও দেখুন। আমি আকাশ আটে 'কাঞ্চি' সিরিয়াল করছি, রাত আটটায়।"
সায়ক জানায়, তাঁদের নিজেদের কোনো বাড়ি ছিল না। তাই পরিবারকে একটি স্থায়ী সম্বল দেওয়ার জন্য তিনি ছোট থেকেই উদ্যত হন। শিশু শিল্পী হিসেবে যে একশো টাকা করে পেতেন, তা জমিয়ে রাখতেন। সেই টাকা থেকে কয়েকশো টাকা আলাদা করে নিজের আগামী সম্বলের জন্য সঞ্চয় রাখেন। পরবর্তীতে সেই প্রথমদিকের উপর্জনগুলি মিলিয়েই, সায়ক নিজের ফ্ল্যাট কেনেন। মায়ের সঙ্গে আনন্দের সেই মুহূর্তে ভাগ করে নিয়েছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সায়ক কিন্তু একেবারেই অন্যান্য অভিনেতাদের মত স্বাস্থ্য সচেতন নন। বরং বেজায় খাদ্যরসিক। তাঁর বিস্ময় 'পরিদর্শক' এর কাছে, "খুব খাই আমি, তাও সেই অর্থে মোটা হইনি! শরীরচর্চাও করতে হবে জানি। কিন্তু খাওয়া সংযম যে মানুষ কিভাবে করেন, আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি..।"