তিনি ছিলেন প্রেম ও প্রকৃতির চির সাধক! পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর, তারই মাধুরীকে আপন মনে মিশিয়ে, তিনি তাঁর জগৎ রচনা করেছেন। সাধারণ মানুষ সেই জগতের কিছু সান্নিধ্য পেয়েছেন, কিছু পাননি। জীবনের যেকোনো অনুভবের প্রতি তাঁর প্রকাশের অসীমতা হয়তো বোঝার মত, এখনও তাঁর ভক্তদের মন তৈরি হয়নি! তাই সৃষ্টি হয়েছে সেই নিয়ে বিতর্কও! রবীন্দ্রনাথ এবং আর্জেন্টাইন লেখিকা, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সম্পর্কটিও ছিল সাধারণের বোধগম্য হওয়ার বাইরে! কেউ এই সম্পর্ককে নিছক 'প্রেম' ঠাওরান, কেউ বা বিশেষ 'বন্ধুত্ব'! এই সমীকরণের বীজকেই সেলুলয়েডে পুঁতে, 'থিনকিং অফ হিম' (Thinking Of Him) নামের মহীরুহের আকার দিয়েছেন, আর্জেন্টিনার পরিচালক, পাবলো সিজার (Pablo César)।
স্বয়ং কবিগুরুর চরিত্রে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত বাঙালি অভিনেতা, ভিক্টর ব্যানার্জী (Victor Banerjee)। যদিও এই চরিত্রে আগে মনোনীত করা হয়েছিল, নাসিরুদ্দিন শাহ্কে (Naseeruddin Shah)। ভিক্টর ব্যানার্জী তাঁর কেরিয়ারের শুরুতে রবি ঠাকুরের লেখা, সত্যজিত রায় পরিচালিত 'ঘরে বাইরে' দিয়ে তাঁর আসন্ন যাত্রাকে সুগম করেছিলেন। আবার তিনি রবীন্দ্র-যাত্রায় সারথি হলেন। এখন তিনি স্বয়ং বিশ্বকবির ভূমিকায়। একটি সংবাদমাধ্যমে তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এই ছবি কোনো বাঙালির দৃষ্টিতে তাঁদের প্রাণের দোসর, রবীন্দ্রনাথকে দেখা নয়! এই ছবি হল, রবীন্দ্রনাথের আর্জেন্টাইন প্রেয়সী, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর (Victoria Ocampo) দৃষ্টিতে তাঁকে দেখা!
গল্পের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে গেলে, আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯২৪ সালে। পেরুর উদ্যেশ্যে জলপথে গমন করছিলেন বিশ্বকবি! সেই সময়ে তিনি আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই মুহূর্তে তাঁর জলযানটি ছিল আর্জেন্টিনার সীমান্তে। তাঁর অসুস্থতার খবর কানে আসা মাত্রই, আর্জেন্টিনার সম্ভ্রান্ত পরিবারের লেখিকা, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তৎক্ষণাৎ বিশ্বকবির আরোগ্য লাভের সমস্ত আয়োজন করতে তৎপর হন। ততদিনে তিনি 'গীতাঞ্জলি'র ফরাসি অনুবাদের মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন। তাই বিশ্বকবির আতিথেয়তা করার সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেননি। ষাটোর্ধ কবির সেবায় নিজেকে নিবেদিত প্রাণ করে তোলেন এই বছর তিরিশের আর্জেন্টাইন লেখিকা।
১৯২৫ সালের জানুয়ারী মাসে, ওকাম্পোর সেবায় সুস্থ হয়ে, আর্জেন্টিনা থেকে বিদায় নেন রবীন্দ্রনাথ। সেই থেকেই শুরু হয় তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে কল্পনা-জল্পনা। তাঁদের মধ্যে যে কিসের সম্পর্ক ছিল, তা সঠিক ভাবে উদঘাটন করতে কেউই সমর্থ হননি! ঠিক যেভাবে, রবীন্দ্রনাথ নিজ সৃষ্ট চরিত্রদের মধ্যে সম্পর্কের সমীকরণে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেন, ঠিক যেমন তাঁর চরিত্রেরা দেশ, কাল, সময়, বয়স সবকিছুর গণ্ডিকে অতিক্রম করে বৃহৎ হয়ে ওঠে, সেই জমি তিনি নিজের ক্ষেত্রেও পোক্ত করে তুলেছিলেন।
প্রায় একশো মিনিটের এই ছবিটি, দুটি পর্যায়ক্রমে দৃষ্ট হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ এবং ভিক্টোরিয়ার সম্পর্কের রসায়নের অধ্যায়টি, যেটি সাদা কালো ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। ভিক্টর ব্যানার্জী প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন, সম্পর্ক মানেই তা কখনোই শরীরী নয়! বরং আত্মীক সম্পর্কই রবীন্দ্রনাথের মুখ্য ছিল। যে সম্পর্ক কখনো আধ্যাত্মিকতার স্থানে উপনীত হতো! কারণ তাঁর কাছে, পূজা এবং প্রেম দুইই যেন সমার্থক।
ছবিটির দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে, এই যুগে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনায় তথা দেশের বাইরে কতদূর গ্রহণযোগ্য! বলা বাহুল্য, এই পর্যায়টি সমসাময়িক, এবং রঙিন। এক আর্জেন্টিনীয় যুবকের শান্তিনিকেতনে আসা এবং স্থানীয় যুবতী কোমলি, ওরফে রাইমা সেনের (Raima Sen) মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করা।
পরিচালক পাবলো জানিয়েছেন, এই যুগে দাঁড়িয়েও আর্জেন্টিনায়, আর্জেন্টিনীয় লেখকদের তুলনায়ও রবীন্দ্রনাথের কদরই প্রাধান্য পায় বেশি। আর্জেন্টিনা এবং ভারতের মধ্যে যদি কোন যোগসূত্র থাকে, তাহলে সেটি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করবার আকাঙ্খা, তাঁর বছর দশেকের বেশি আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে।
এই ছবিতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, আর্জেন্টাইন অভিনেত্রী এলিওনোরা ওয়েক্সলার (Eleonora Wexler) । আর্জেন্টাইন যুবকের চরিত্রে আছেন হেক্টর বরদনি (Héctor Bordoni)।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে, সারা দেশে আগামী ৬ মে মুক্তি পেতে চলেছে ইন্দো-আর্জেন্টিনীয় এই ছবি ‘থিংকিং অফ হিম’।