মানুষ কতটা বড় হলে তাঁর চলে যাওয়াকে বলা হয় 'মহাপ্রয়াণ'? কতটা বড় হলে মানুষ চলে যাওয়ার পরে 'তারও অধিক থেকে যায় তার না-থাকা'? এসব প্রশ্নের উত্তর, যুক্তি-তর্ক যেখানে, সেখান থেকে অনেক দূরে আজ চলে গেলেন বাংলার সংস্কৃতির, ভারতীয় চলচ্চিত্রের নক্ষত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর চলে যাওয়া আমাদের বুঝিয়ে দিল, নক্ষত্র যত বড় হয়, তার পতনের পর নিস্তব্ধতা হয় তত গভীর।
অপু-র স্বপ্ন-মাখা দু-চোখ আর সারল্য মাখা হাসি, ফেলুদার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত চোখের সঙ্গে বাঙালিয়ানার আশ্চর্য মিশেল, কখনও 'কে তুমি নন্দিনী' গানে ট্যুইস্ট নাচ থেকে চোয়াল শক্ত করা দৃঢ় প্রত্যয়ী "ফাইট কোনি, ফাইট" - প্রায় ছয় দশকেরও বেশী সময় ধরে বাংলা তো বটেই, ভারতীয় সিনেমায় একের পর এক মাইলস্টোন দিয়ে গেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
১৯৩৫-এ কলকাতায় জন্মালেও তাঁর জীবনের প্রথম ১০ বছর কাটে কৃষ্ণনগরে। মফস্বলের ছোট্ট শহরে কাটানো এই সময়টার প্রভাব যে তাঁর জীবনে ছিল বিশাল, এ কথা বহু জায়গায় বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উঠে এসছে তাঁর গলায়। ছাত্রজীবনেই প্রবাদপ্রতীম বাংলা থিয়েটারের অভিনেতা-পরিচালক অহীন্দ্র চৌধুরীর কাছে অভিনয়ের হাতেখড়ি তাঁর। এরপর অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে অ্যানাউন্সার-এর কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু হলেও তাঁর জীবন আমূল পাল্টে যায় সত্যজিৎ রায়ের সংস্পর্শে এসে।
সালটা ১৯৫৬। সত্যজিৎ রায় তখন অপরাজিত সিনেমার জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন। সে সময়েই তাঁর সাথে আলাপ সৌমিত্রর। সে আলাপ ধীরে ধীরে গড়ায় বন্ধুত্বে। এরপর, ১৯৫৮ তে মানিকবাবুর 'জলসাঘর' সিনেমার শ্যুটিং-এর সময়ে নিয়মিত সেট-এ গেলেও তখনও তিনি জানতেন না, 'অপুর সংসার'-এর জন্য ততদিনে তাঁকে বেছে নিয়েছেন সত্যজিৎ। অপুর সংসার সিনেমায় অপু-র চরিত্রের জন্য সত্যজিৎ চেয়েছিলেন তারকাসুলভ গ্ল্যামারের চাকচিক্য থেকে অনেক দূরে একটা সরল অথচ বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। আর তার অভিজ্ঞ চোখ চিনে নিতে ভুল করেনি বাংলা সিনেমার এই অমূল্য সম্পদকে। সৌমিত্র তখনও টের পাননি, এই একটা সিনেমা তার জীবন পাল্টে দেবে আমূল। ১৯৫৯-এ মুক্তি পায় 'অপুর সংসার', আর তার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সিনেমায় শুরু হল এক নতুন নক্ষত্রের পথ চলা। উত্তম কুমারের মত তারকার ঔজ্জ্বল্যের পাশে দাঁড়িয়েও নিজের স্বতন্ত্র জায়গা করে নেওয়া চিনিয়ে দিয়েছে তাঁর অভিনয় প্রতিভা।
এরপর বহু চলচিত্রে কাজ করলেও শিশুদের মধ্যে সৌমিত্র প্রথম তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ফেলুদার হাত ধরে, ১৯৭৪ সালে সোনার কেল্লা সিনেমায়। ধূ ধূ বালির ওপর দুর্ধর্ষ দুশমন কে ধাওয়া করা, মগজাস্ত্র দিয়ে অপরাধীদের ঘায়েল করা থেকে "ছটা গুলি, ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই" ফেলুদার চূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেন চিরকালের ঘরকুনো, নিরাপদে জীবন কাটিয়ে দেওয়া বাঙালিকে এনে দিলেন অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ। সে ছাপ এতই গভীর যে, এখনও তাঁর দীর্ঘ ছায়া থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি ফেলুদা চরিত্র। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাবলীলতা এতটাই মুগ্ধ করেছিল সত্যজিৎ রায়কে যে, ফেলুদার চিত্রনাট্য থেকে ইলাস্ট্রেশন - সবেতেই অলক্ষ্যে ছাপ পাওয়া যায় তাঁর। তবে শুধু ছোটদের মধ্যেই না, সব বয়সের মানুষদের মধ্যেই যে ফেলুদা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে সোনার কেল্লা-র ফেলুদার আবির্ভাবের পর প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি পরা বাঙালির স্টাইল স্টেটমেন্ট হয়ে যাওয়া দেখে।
বলা হয়, বিভিন্ন সময়ের তাবড় অভিনেতারা যে সমস্ত চরিত্রে বা পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার স্বপ্ন দেখেছেন তাদের কেরিয়ারে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একার কাছেই সে সমস্ত চরিত্র, চিত্রনাট্যরা এসে ধরা দিয়েছে। তা নাহলে 'অপুর সংসার' ছবিতে অপু-র চরিত্র দিয়ে পর্দার অভিনয় জীবন শুরু করে, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, তপন সিনহা-র মত পরিচালকদের পাশাপাশি স্বপন সাহা, সন্দীপ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন আবার নতুন প্রজন্মের সৃজিৎ মুখার্জী, শিবপ্রসাদ-নন্দিতা অথবা লীনা গঙ্গোপাধ্যায়-শৈবাল ব্যানার্জী জুটি - অভিজ্ঞতা ও অভিনয়ের এই পরিমাণ ব্যপ্তি, এত বিভিন্ন রঙের কোলাজ ভারতবর্ষে তাঁর সমসাময়িক আর কোন অভিনেতার আছে কিনা সন্দেহ। জীবনের শেষ বয়স অবধিও তাঁর সমান উদ্যমে কাজ করে যাওয়া প্রমাণ করে অভিনয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। 'প্রাক্তন', 'বেলাশেষে'-র মত নিখাদ প্রৌঢ়ত্বের প্রেমের গল্প যেন তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণই থেকে যেত।
পর্দায় অসামান্য অভিনয়ের জন্য দাদাসাহেব ফালকে পুরষ্কার, জাতীয় পুরষ্কার, পদ্মভূষণের পাশাপাশি ২০১৮-তে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'লিজিয়ন অফ অনার'- এসব তো তাঁর পুরষ্কারের তালিকায় থাকলোই, কিন্তু সব ছাপিয়েও জীবনের শেষ দিন অবধি অফুরান প্রাণশক্তিতে কাজ করে যাওয়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালির কাছে এক চির-অনুপ্রেরণা, যিনি ৭০ পেরিয়েও বলতে পারেন, "আমি অভিনয়টা ছাড়া কিছু পারিনা, তাই আর কিছু করিনা", যিনি এই ভেতো, চিরকাল নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা, জীবনে ঝুঁকি নিতে ভয় পাওয়া বাঙালির সামনে দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে চিৎকার করবেন "ফাইট কোনি, ফাইট!"