"মেয়েলি পুরুষ"-এর ট্যাবু ছেড়ে বেরোতে পারেন না অনেকেই। 'নিউ নর্মাল' সময়েও অন্য রকমকে মেনে নিতে পারেন না ওঁরা। সেই সময় ট্রান্সজেন্ডারকে স্ক্রিনের বিষয় করেছিলেন কৌশিক গাঙ্গুলি। নগরকীর্তন চলচ্চিত্রে এক ট্রান্স চরিত্রে রূপদান করে সমাজকে বার্তা দিলেন ঋদ্ধি সেন। বললেন, "অভিনেতা হিসেবে আমার মা আর বান্ধবীকে দেখে মেয়েদের জগত বুঝেছি। আমার ভালো লেগেছে এই চ্যালেঞ্জ নিতে"।
বাংলায় এই পুরুষ দ্বারা নারী চরিত্র অভিনয়ের ট্রাডিশন বহুদিনের। আমরা যদি একদম ইতিহাসের পাতায় ফিরে যাই এবং সেখান থেকে আজকের দিন দেখার চেষ্টা করি তাহলে দেখবো প্রাথমিকভাবে অভিনয়ে মহিলাদের না আসা থেকে পুরুষ বাধ্য হয়ে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতেন। বাংলা থিয়েটারেও প্রায় ১০০ বছর বাংলা মঞ্চে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেছেন পুরুষরাই। তারপর মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং বেঙ্গল থিয়েটারের হাত ধরে মঞ্চে মহিলাদের আসার শুরু। এলোকেশী, গোলাপসুন্দরী, শ্যামাসুন্দরী এবং জগত্তারিনি বাংলা মঞ্চে আসা প্রথম মহিলা।
যদিও অ্যান্ড্রোজিনি নিয়ে চর্চা চলেছে। অভিনেতা তার লিঙ্গের বিপরীত লিঙ্গের চরিত্রে অভিনয় করলে বলে অ্যান্ড্রোজিনি। যে সময়ে অ্যান্ড্রোজিনি বিষয়ে আলোচনা এবং চর্চা শুরু তখন কিন্তু ট্রান্স জেন্ডার চরিত্রে অভিনয় নিয়ে মানুষ ভাবেনি। গিরিশ পুত্র দানীবাবু মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেছেন, অমৃতলাল মিত্র করেছেন, নারী চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছেন শরতচন্দ্র ঘোষ, বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়। আজও চপল ভাদুড়ি জীবিত। কদিন আগে গোর্কি মা অবলম্বনে নির্মিত "মা" ছবিতে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন গৌতম মুখোপাধ্যায়।
সিনেমায় জেন্ডার পলিটিক্সকে বারবার প্রশ্ন করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। একের পর এক ছবিতে তিনি তুলে ধরেছেন লিঙ্গ বৈষম্য ও সমাজের কটাক্ষকে। "চিত্রাঙ্গদা" ছবিতে তিনি রবি ঠাকুরকে হাতিয়ার করেই রচনা করেছেন এক ভাষ্য যা প্রশ্ন করে সমাজকে। তবু সমাজের "ট্যাবু" গেল কি? এন্ড্রোজিনি নিয়ে দীর্ঘদিন থিয়েটারে কথা বলছেন রাকেশ ঘোষ। তিনি বলেন, "মানুষের ভাবনা বদলাচ্ছে। ধীরে হলেও।"
সেই বদলের হাওয়ায় বড় এক জোর "নগরকীর্তন"। ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া কৌশিক গাঙ্গুলীর সিনেমা নগরকীর্তনে ঋদ্ধি সেন অভিনয় করেছেন এক ট্রান্স জেন্ডার মহিলার ভূমিকায়। নগরকীর্তন সিনেমার মূল ভাবনার দিকে আলোকপাত করলে বোঝা যায় "A woman feels trapped inside a man's body." নগরকীর্তন সিনেমা নির্মাতাদের পক্ষে সিনেমার মূলভাব বলা হয়েছে এটাই। এ ছবিতে অন্যতম অভিনেতা ঋত্তিক চক্রবর্তী। তিনি খুবই উত্সাহী এই ছবি নিয়ে। "আসলে আমরা বাইরেটা নিয়ে ভাবি। আমরা মন নিয়ে, মানুষ নিয়ে ভাবিনা", বললেন অভিনেতা। এ সিনেমায় ঋদ্ধি অভিনীত চরিত্র 'পুঁটি', ঋত্বিক চক্রবর্তী অভিনীত চরিত্র 'মধু'-র প্রেমে পরে এবং দুজনে টাকা জমাতে শুরু করে পুঁটি কে অপারেশনের মাধ্যমে মহিলা করে তোলার জন্য। কিন্তু সমাজ আপত্তি জানায়। ঘটনাচক্রে নিগৃহীত হয় পুঁটি। সিনেমার উপজব্যও সেটাই। লকআপে পড়ে থাকা পুঁটির নিথর দেহ সমাজের গালে সপাটে থাপ্পড় যেন!
বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমায় অ্যান্ড্রোজিনি দেখা যায়নি সেইভাবে। তাই ঋদ্ধির এই প্রয়াস এবং পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলীর সাহসী পদক্ষেপ প্রশংসিত হচ্ছে সব জায়গায়। আরও বিশেষভাবে সমাজ যে নামেই একটা আধুনিকতার মুখোশ পরে থাকে আর ভিতরে ভিতরে সেই প্রাচীন গোঁড়ামিটা পুষে রাখে সেটা পরিচালক যেভাবে দেখিয়েছেন সিনেমায় সেটা এই মিথ্যে মুখোশ পরা সমাজের মুখে চপেটাঘাত বলে মনে করছেন প্রায় সকলেই।