টলিপাড়ার মৌনমিছিলে যারা সামিল হননি, তাঁদের নিয়ে 'গভীর ভাবে' ভাবা হবে! এমনই এক বিবৃতিতে উত্তাল টলিপাড়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সর্বত্র। কিন্তু কেন? কীসের এই মৌনমিছিল? উল্লেখ্য, 'টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় চলছে মাফিয়ারাজ'- সম্প্রতি হাওড়ার এক জনসভায় বিজেপির ভবানীপুর কেন্দ্রের প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষ দাবি করেছিলেন এমনটাই। এর জেরেই কার্যত ‘ফেডারেশন’কে কালিমালিপ্ত করার প্রতিবাদে রবিবার ‘ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ আয়োজিত এক মৌনমিছিল সংগঠিত হয়। যেখানে চৈত্রের কড়া তাপপ্রবাহ মাথায় নিয়েও উপস্থিত ছিলেন বহু কলা-কুশলী। আবার অনুপস্থিত ছিলেন অনেকেই। আর তাতেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন স্বরূপ বিশ্বাস এবং অপর্ণা ঘটক। কে এই স্বরূপ? রাজ্যের মন্ত্রী তথা টালিগঞ্জের বিদায়ী বিধায়ক অরূপ বিশ্বাসের ভাই হলেন স্বরূপ বিশ্বাস, যিনি শিল্পীদের সংগঠন ফেডারেশনকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেন।
কেন অধিকাংশ কলাকুশলীদের অনুপস্থিতে জমায়েত হয়নি মৌনমিছিলে? এনিয়েই স্বরূপ বিশ্বাস বলেন, "ফেডারেশনের তরফ থেকে প্রত্যেককে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ এই মিছিলে উপস্থিত থাকার জন্য। পাশাপাশি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, যে সমস্ত স্বনামধন্য কলাকুশলীরা যেমন পরিচালক, চিত্রশিল্পী, ক্যামেরা পার্সন, রূপটান শিল্পী প্রমুখেরা আজকের এই ঐতিহাসিক মিছিলে যোগদান করলেন না, ফেডারেশনের অপমানের বিরোধিতা করলেন না, আগামী দিনে ফেডারেশন তাদের নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করবে।"
এই ‘গভীর চিন্তা ভাবনা’র অর্থ কী? তা চিন্তায় অনুপস্থিত কলাকুশলীরা। এ নিয়ে টলিগঞ্জ বিধানসভার বিজেপি প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় লেখেন, "অরূপ বিশ্বাসের 'সুযোগ্য' ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের 'চরম নৈরাজ্যের ক্যাপ্টিনশিপ-এ' 'ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ানস্ অ্যান্ড ওয়ার্কার্স্ অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া' তরফে এটি জারি করা হয়েছে। এই দুই ভাই যারা নিজেদের 'সর্বশক্তিমান বাহুবলি' মনে করে। শেষের চারটি লাইন পড়ুন কি ভাবে স্পষ্ট ভাষায় 'ধমকি' দেওয়া হয়েছে'।"
'গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করা হবে'- এমন মন্তব্যের পরে ফের মুখ খুললেন বিজেপি প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষ। গত সোমবার তিনি বলেন, "ইন্ডাস্ট্রিতে মাফিয়ারাজ চলছে। যার ফল ভুগছেন অসংখ্য কলাকুশলী। প্রতিভার এখানে কোনও জায়গা নেই। ফেডারেশনের সমর্থন থাকলে, সংগঠনের কার্ড থাকলেই এখানে কাজ করতে পারেন যে কেউ। নয়ত নয়।" এরপরেই স্বরূপ বিশ্বাসের এহেন বক্তব্যকে নিয়ে তিনি আবারও বলেন, "রবিবারের মিছিলে যাঁরা সামিল হয়েছেন, তাঁরা ফেডারেশনের ভয়ে ভীত। স্রেফ রুজিরুটির তাগিদে যোগ দিয়েছেন তাঁরা। এ কথা অনেকেই আমাকে আগেও জানিয়েছেন। এ বারেও বলেছেন। কেন এই ভয় কাজ করবে সকলের মনে? এই মনোভাব কাজের পরিবেশ নষ্ট করে দেয়।"
অন্যদিকে, মৌনমিছিলে অনুপস্থিত পরিচালক সঙ্ঘমিত্রা চৌধুরী বলেন, "রুদ্রনীল ঘোষ একেবারেই কলাকুশলীদের মাফিয়া বলেননি। বলেছেন মন্ত্রী স্বরূপ বিশ্বাস এবং ফেডারেশন সভাপতি অরূপ বিশ্বাসকে। মিছিল বার করাটা বড় কথা নয়। খারাপ লেগেছে, ভয় দেখিয়ে জোর করে মিছিলে লোকজনকে সামিল করা। কাজ চলে যাবে, কার্ড নিয়ে নেওয়া হবে, আগামী দিনে কাজ পাবে না! এই ভয় দেখিয়ে অনেককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। টলিউডে এই মুহূর্তে বহু পরিচালক, কলাকুশলীর হাতে কাজ নেই। তারকারা সে জন্যই দলে দলে যোগ দিচ্ছেন রাজনীতিতে। তার উপর এ ভাবে যদি হুমকি, ধমকি দেওয়া হয়, তা হলে ফল আরও ভয়ঙ্কর হবে।"
তবে "ভয় দেখিয়ে মিছিল করানোর" অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস দাবি করেন, ‘‘সকলেই প্রশংসা করেছেন। কেউ কোনও বিরোধিতা করেননি। তার পরেও যদি কেউ কিছু বলে থাকেন, তা হলে বলব, এক দল ঘাম ঝরিয়ে মিছিলে হাঁটবেন আরেক দল বাড়িতে বসে আরাম করে বিরোধিতা করবেন- এই মানসিকতা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, এই লড়াইটা কিন্তু সকলের।’’ অভিনেত্রী তথা বিজেপি নেত্রী রূপাঞ্জনার কথায়, “এ সব কী হচ্ছে? 'ভেবে দেখা' বলতে কী বোঝাচ্ছে ফেডারেশন? আরও পরিষ্কার করুক!”
এরপরেই স্বরূপ বিশ্বাসের মন্তব্যে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন ‘আর্টিস্ট ফোরাম’-এর সদস্য এবং অভিনেতা কৌশিক সেন। তিনি স্পষ্ট বলেন, "তৃণমূল ফের ক্ষমতায় এলে, স্বরূপ বিশ্বাসকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা উচিত মুখ্যমন্ত্রীর।" তবে নবান্নে আর্টিস্ট ফোরাম এবং টেকনিশিয়ানদের বৈঠক চলাকালীন স্বরূপের আচরণে ক্ষুব্ধ হন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও। এরপরই দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূল যুব সংগঠনের সভাপতির পদ থেকে স্বরূপকে সরিয়ে দেন তিনি।