'আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু', বছর শেষে ঝড়া পাতার, আরও একবার উড়ে এসে নতুন বছরের আগাম বার্তা জানানোর সময় আগত। কিন্তু এই নতুনের আগমন হয়, অনেক হারিয়ে ফেলা মুহুর্তের বিনিময়। আর সেই মুহুর্তে থেকে যান, আমাদের কাছের মানুষও। চলতি বছর ধরে আমরা হারিয়েছি, এমন কিছু ব্যক্তিত্বকে, যাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ভারতীয় সংস্কৃতি মহলের অন্যতম পথপ্রদর্শক। বছর, শেষের মুখে। এই মুহুর্তে একবার ফিরে দেখতে চাওয়া সেই সকল, অনেক তারার মাঝে হারিয়ে যাওয়া তারাদের।
শাঁওলি মিত্র- ভারতীয় নাট্য ইতিহাসের অন্যতম পথিকৃৎ শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের কন্যা, শাঁওলি মিত্র (Shaoli Mitra) এই যুগের সকল নাট্য গোষ্ঠীর অন্যতম অভিভাবক ছিলেন। শৈশবে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী নাটক 'ডাকঘর' এ অমলের ভূমিকায় অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়ে দেন। 'পঞ্চম বৈদিক' নাট্যগোষ্ঠীর স্রষ্টা, শাঁওলি মিত্র চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৬ জানুয়ারি, মাত্র ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় 'নাথবতী অনাথবৎ' খ্যাত এই কিংবদন্তী অভিনেত্রীর।
নারায়ণ দেবনাথ - আমাদের শৈশব ছিল তাঁর হাতের লিখনে। আমরা বড় হয়ে উঠেছিলাম 'নন্টে ফন্টে'র দুষ্টুমির সঙ্গে হোক, কিংবা দুষ্টু লোকেদের শাস্তি দেওয়া 'বাঁটুল দি গ্রেট' এর সাহস ও শক্তি নিয়ে। আর তাঁদের সৃষ্টিকর্তা, নারায়ণ দেবনাথ (Narayan Debnath)। এই বছর আমাদের শৈশবকেও চোখে আঙুল দিয়ে হারিয়ে ফেলার বছর। ১৮ জানুয়ারি, ৯৬ বছর বয়সে হাওড়ার বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, আমাদের শৈশবের সেই কারিগর। তাঁর মৃত্যুতে সকলে শোকাহত হয়ে পড়েন।
লতা মঙ্গেশকর- 'আসমান কে নীচে' (Aasman Ke Neeche) আর থাকা হল না সুরের সম্রাজ্ঞীর। চলতি বছর ৬ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ অসুস্থতার পর আকাশের তারাদের মাঝে সামিল হন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের নক্ষত্র লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় - শঙ্খ জ্বালিয়ে মাকে ঘরে আনা হলেও, তিনি আর ঘরে ফেরেননি। ৯০ বছর বয়সে, কলকাতার এক হাসপাতালে ১৫ ফেব্রুয়ারি জীবনাবসান হয় 'গীতশ্রী' সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের (Sandhya Mukhopadhyay)। জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত তাঁর কেটেছে সঙ্গীতের মাধ্যমে। শোনা যায়, মৃত্যুর আগে তিনি শেষ শুনেছিলেন, প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দের বিখ্যাত গান, 'শহর থেকে আরও অনেক দূরে'।
বাপ্পি লাহিড়ী - ১৫ ফেব্রুয়ারি আরও একটি অভিশপ্ত দিন, ভারতীয় সঙ্গীত জগতের ইতিহাসে। 'ডিস্কো কিং' হিসেবেই মূলত পরিচিত সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী (Bappi Lahiri), জীবনের বেশিরভাগ সময়ে গান দিয়ে মানুষের মন জয় করে বিনোদন দিলেও, তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্ত ছিল মর্মান্তিক। মাত্র ৬৯ বছর বয়সে, ঘুমের মধ্যেই স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়ে মৃত্য ঘটে তাঁর। তাঁর অনুগামীসহ সারা ভারতবাসী, তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যুশোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন।
অভিষেক চট্টোপাধ্যায়- এই বছরেই টলিউড ইন্ড্রাস্ট্রিতে একটি বড়সর দুর্যোগ নেমে আসে। সেই দুর্যোগ ঘনীভূত হয় অভিনেতা অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের (Abhishek Chattopadhyay) মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। মাত্র ৫৭ বছর বয়সী এই অভিনেতার মৃত্যু মানতে পারেননি তাঁর পরিবার থেকে সহকর্মী কেউই। শুটিং চলাকালীনই অভিনেতা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি তাঁর প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য সহকর্মীরা তাঁকে চিকিৎসাধীন হতে বললে, তিনি তা গুরুত্ব দিতেন না। অবশেষে যা ঘটার ঘটেই গেল। ২৪ মার্চ, তাঁর বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় তাঁর নিথর দেহ। স্ত্রী এবং কন্যা নিয়ে ছিল তাঁর সুখের ঘর। এক মুহুর্তে সবকিছু তাসের ঘরের মত ভেঙে গেল।
তরুণ মজুমদার - ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম কান্ডারী হলেন তরুণ মজুমদার (Tarun Majumdar)। ৪ জুলাই, এই নক্ষত্রের পতন ঘটে। মৃত্যুর পূর্বে 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' (Shriman Prithviraj) খ্যাত পরিচালকের শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য, তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ চিকিৎসক বাহিনী। কিন্তু সকল চেষ্টা যায় বিফলে। 'ভালোবাসা ভালবাসা' এ আর সাড়া দিলেন না তরুণ মজুমদার। চিরকালের মত চলে গেলেন ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে।
নির্মলা মিশ্র- তোতা পাখি নয়, বরং সকল শিকল ছিন্ন করে নিজেই মায়ের দেশে পাড়ি দেন নির্মলা মিশ্র (Nirmala Mishra)। গত ৩০ জুলাই, তাঁর চেতলার বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। ৩১ জুলাই রাত ১২.০৫ নাগাদ চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয় ৮১ বছর। স্বামী, পুত্র এবং পুত্রবধূ নিয়ে ছিল তাঁর ভরাট সংসার।
ঐন্দ্রিলা শর্মা- সকলের চেয়ে বয়সে ছোট, এবং সকলের চেয়ে বেশি যাঁর মৃত্যু এই বছর সকলকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, তিনি অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা (Aindrila Sharma)। প্রায় ২২ দিনের লড়াইয়ে, শারীরিক ভাবে হার মানেন ২৪ বছর বয়সী ঐন্দ্রিলা। দু বার তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছিল ক্যান্সার। সাময়িকভাবে জয়ী হলেও, শেষ রক্ষা হয়নি ছোট পর্দার 'ঝুমুর' এর।