'বেলাশেষে'র (Belaseshe) সাত বছর পর, আবার পর্দায় তাঁরা 'সোহাগে আদরে' ধরা পড়বেন, শেষবারের মত! পর্দায় আরতি এবং বিশ্বনাথের চরিত্রকে মায়ায় জড়িয়েছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত (Swatilekha Sengupta) এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee)। সেই যাত্রাই 'বেলাশুরু' (Belashuru) হয়ে দাম্পত্যের নতুন পথ বিস্তৃত করবে। আজ, ২০ মে মুক্তি পাচ্ছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Shiboprosad Mukherjee) এবং নন্দিতা রায় (Nandita Roy) পরিচালিত, 'বেলাশুরু' ছবিটি।
বাংলা সিনেমা জগতকে, শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটি যেন নতুন করে সোনার কাঠি ছুঁইয়েছিলেন। যেখানে পর্দার ভেতর আর বাইরে কোন ব্যবধান নেই। রুপোলি জগৎ এবং অ-রুপোলি জগৎ মিলেমিশে একাকার হয়। সহজ সরল জীবনের বুনিয়াদ, মানসিক টানাপোড়েন, সম্পর্কের বাস্তবিক 'ক্রাইসিস' হয়ে ওঠে তাঁদের ছবির উপজীব্য। প্রকাশের আঙ্গিক এতই ঘরোয়া হয়, ঠিক যেন বাস্তবের প্রতিফলক। আজ মুক্তি পাচ্ছে 'বেলাশুরু', আজ আবার পরিচালক শিবপ্রসাদের জন্মদিন। তাই আজ তাঁর এই বিশেষ দিনে, আড়াই বছর আগে সমাপ্ত হওয়া কাজটি বহু জটিলতা পেরিয়ে, সহস্র বন্ধন মাঝে মুক্তির স্বাদ নিতে উদ্যত।
১৯৭৪ সালে, ২০ মে কলকাতার বরানগরে জন্মান, সকলের প্রিয়, আজকের 'শিবু'। উত্তর কলকাতার ছেলে শিবপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ মিশন ও হিন্দু স্কুলে যথাক্রমে তাঁর প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেন। থিয়েটার-প্রেমী 'শিবু' স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই, বিখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব শ্রী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের কাছ থেকে থিয়েটারের তালিম নিতে থাকেন। সঙ্গে শুরু করেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে ছবির কাজ। তাঁর পরিচালনায় শিবপ্রসাদ 'দহন', 'বাড়িওয়ালী'র মত বিখ্যাত ছবিগুলিতে অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটান। ১৯৯৫ সালে টেলিভিশন জগতে অভিষেক হয় তাঁর। 'একুশে পা', 'জন্মভূমি', ঘুম নেই' র মত জনপ্রিয় ধারাবাহিকগুলিতে অভিনয় করেন শিবপ্রসাদ।
নন্দিতা রায়ের সঙ্গে সমবেত হয়ে, যৌথ ভাবে 'উইন্ডোজ প্রোডাকশন' (Windows Production) প্রযোজনা সংস্থা গড়ে তোলেন। তখন থেকেই তাঁদের সাফল্যের আকাশ 'রামধনু' রঙে প্রকট হতে থাকে। প্রয়াত লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস, 'ইচ্ছে গাছ' কে নিয়ে তাঁরা বানান তাঁদের প্রথম ছবি, 'ইচ্ছে'। ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি, সন্তানের প্রতি তাঁর মায়ের উচ্চাভিলাষ এবং প্রয়োজনের বেশি অধিকারবোধ কিভাবে তাঁদের জীবনের মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, সেই গল্প বুনন করে। প্রথম ছবিতেই এই জুটি তাঁদের জমি পোক্ত করে তুলতে সমর্থ হন।
এরপর তাঁদের মুকুটে পালক জুড়তে থাকে, 'অলীক সুখ', 'অ্যাক্সিডেন্ট', 'মুক্তধারা', 'রামধনু','বেলাশেষে', 'প্রাক্তন' 'পোস্ত','হামি, 'কন্ঠ'র মত ছবি। ঘরোয়া বুননে তৈরি হয়েও, সকল বয়সের মানুষের মনে শক্তিশালী ভাবে দাগ কাটে ছবিগুলি।
'অ্যাক্সিডেন্ট', 'রামধনু', 'হামি', 'কণ্ঠ' তে শিবপ্রসাদ স্বয়ং নিজে অভিনয় করেন। এর মধ্যে 'কণ্ঠ' ছবিতে তাঁর চরিত্রটি ছিল সবচেয়ে 'চ্যালেঞ্জিং'। কণ্ঠশিল্পী অর্জুন মল্লিকের পেশায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় ল্যারিঞ্জেকটমি। ক্যান্সারে তিনি হারান তাঁর স্বরযন্ত্রকে। এই পরিস্থিতিকে জয় করে, পুনরায় তাঁর কর্মক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন নিয়েই আবর্তিত হয়েছিল ছবিটি। প্রতিটি ফ্রেমে অর্জুনের অস্তিত্ব সংকট, নিরাপত্তাহীনতা, এবং সংগ্রামকে পুঙ্খানপুঙ্খভাবে পর্ট্রে করেছেন শিবপ্রসাদ। প্রসঙ্গত, এই ছবি দেখার পর, যেসকল মানুষ তাঁদের ল্যারিংস (Larynx) অর্থাৎ স্বরযন্ত্র হারিয়েছেন, তাঁদের জন্য তৈরি হয়েছে 'কন্ঠ ক্লাব'(Konttho Club / Laryngectomy Club)। পর্দায় অর্জুনের মত তাঁরাও যাতে হারানো জীবনের ছন্দে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারেন, সেই কারণে এই প্রয়াস। ২০১৯ সালের ২৮ মে কলকাতার বুকে প্রথম স্থাপিত হয় 'কন্ঠ ক্লাব'। ২০২০ তে, ১৪ ডিসেম্বর কর্ণাটক সরকারের উদ্যোগে চালু হয়েছে সর্বভারতীয় 'কন্ঠ ক্লাব' বা ল্যারিঞ্জেকটমি ক্লাব।
কচিকাঁচাদের মধ্যেও শিবপ্রসাদ বেশ জনপ্রিয়। তাঁদের নিয়ে করেছেন তিনি একাধিক ছবি। ছোট্ট কুঁড়িগুলির কাছেও তিনি প্রিয় 'শিবুদা'। পরিচালনা না করলেও, অরিত্র মুখোপাধ্যায়ের ছবি 'বাবা বেবি.. ও' ছবির প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন শিবপ্রসাদ এবং নন্দিতা রায়। সেখানেও দুই অভিনেতা, খুদে সদস্যের সঙ্গে শিবপ্রসাদের জমাটি ভাব হয়। এমনকি তাঁদের মন-মর্জি মত শিবপ্রসাদ শ্যুটিংয়ের সময় নির্ধারণ করতেন।
আপাতত বাঙালি মুখিয়ে আছেন, তাঁদের 'হামি' র সিক্যুয়েল, 'হামি ২' মুক্তোর আশায়। সম্প্রতি তাঁরা ঋতাভরী চক্রবর্তী (Ritabhari Chakraborty) ও আবীর চ্যাটার্জী' (Abir Chatterjee) কে নিয়ে 'ফাটাফাটি' (Fatafati) ছবির কাজ শুরু করেছেন, যেখানে তথাকথিত নায়িকা সুলভ অবতারে ঋতাভরীকে না পেয়ে এক অচেনা, ছক ভাঙ্গা স্রোতের ঋতাভরীকে অনুগামীরা পেতে চলেছেন।