'ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলো ধরিত্রীরে', চির সুন্দরের পূজারী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সকল অন্ধকার মোচনের প্রসঙ্গে এমন বাণীতেই বিশ্বলোককে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দুর্গা পুজোর বিষাদ কাটিয়ে উঠে, বাঙালি তথা হিন্দু মেতে ওঠেন আলোর উৎসবে। পুরাণে কথিত আছে, চোদ্দ বছর বনবাসের পর, রাবণকে পরাজয় করে অযোধ্যার যুবরাজ রাম পুনরায় ফিরে আসেন নগরে। দুষ্টের দমনের ফলে চারিদিকে তাঁর জয়জয়কার উদযাপন করা হয়। আলোকিত হয়ে ওঠে অযোধ্যা নগরী। রামের এই জয়কেই, অন্ধকার দূরীকরণে আলোর প্রভাব বিস্তার করা বোঝায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পালন করা হয়ে থাকে দীপাবলি। সংস্কৃত ভাষায় 'দীপ' শব্দের অর্থ হল প্রদীপ, অর্থাৎ আলোকশিখা। 'অবলি' কথার অর্থ সারিবদ্ধ। অর্থাৎ সারিবদ্ধ ভাবে প্রজ্জ্বলিত আলোকশিখা সজ্জাকে কেন্দ্র করে সাধিত হয় দীপাবলি উৎসব। অশুভের বিনাশ ঘটিয়ে তাই প্রভু রামের অযোধ্যা আগমনের দিন আলোর উৎসবে সেজে উঠেছিল বলে সেই থেকেই দীপাবলি পালন করার ভাবনা তৈরি হয়েছে হিন্দু শাস্ত্রে।
আলোর এই উৎসবে (Festival Of Light) পাঁচটি বিশেষ দিন থাকে। আগামী ২১ অক্টোবর থেকে শুরু হবে দীপাবলির প্রথম পর্ব। গোবৎস দ্বাদশী (Govatsa Dwadashi) দিয়ে সূচনা হয় আলোর উৎসব। উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যে বেশ ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয়ে থাকে এই পরব। এই উৎসব আসলে গো-প্রজাতির উদ্দেশ্যে নিবেদন। সারাবছর গরু তথা গবাদি পশুরা আমাদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এই উৎসবে গরু এবং বাছুরকে পুজো করা হয়। গমের দ্রব্য খাদ্য সামগ্রী হিসেবে নিবেদন করা হয় তাদের প্রতি। যদিও উপাসকরা গম এবং দুধ খাওয়া থেকে সেইদিন বিরত থাকেন। তাঁদের বিশ্বাস, এই আচার পালন করলে তাঁদের পরিবারেও সুখ সমৃদ্ধি আসবে।
যেখানে চারপাশ আলোকধারায় সেজে উঠবে, সেখানে মানব-সমাজ সেজে উঠবেন না, এমন হয়? চলতি মাসের ২২ তারিখে পালন করা হবে ধনতেরাস (Dhanteras)। এই উৎসবটি আগে অবাঙালিদের মধ্যেই বেশি প্রচলিত ছিল, কিন্তু বাঙালিরাও সুখ সমৃদ্ধির বাসনায় অবাঙালিদের মতই এই উৎসব পালন করে থাকেন। এই উৎসবে সোনা রূপো কেনার চল রয়েছে। আসলে এই উৎসবে সম্পদ অর্থাৎ দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। ঘরে নতুন সম্পদ আনলে, সুখও যে আসবে, এমনই বিশ্বাস হিন্দুদের।
আলোর উৎসবের অন্যতম মূল পরব হল 'ভূত চতুর্দশী'। অক্টোবরের ২৩ তারিখ হিন্দুরা চোদ্দ শাক খাওয়ার সঙ্গে, পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে চোদ্দ প্রদীপ জ্বেলে থাকেন। পালং, লাল, শুষনি, পাট, ধনে, কুমড়ো পুঁই ইত্যাদি শাক সমাহারে সেজে ওঠে হিন্দুদের পাত। পুরানে চোদ্দ শাক খাওয়ার অনেক ব্যাখ্যা থাকলেও, এটির আলাদা একটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে। আসলে কার্তিক মাসের এই সময় ঋতু পরিবর্তিত হতে থাকে, অর্থাৎ গরমকাল থেকে শীতকালের দিকে যাত্রা শুরু হয়। সেই সময়ে অনেকেই নানা রকম অসুখ বিশুখে আক্রান্ত হন। শাক সবজি শরীরের জন্য রোগপ্রতিরোধক উপাদান। তাই চোদ্দ শাক খাওয়া এই সময়ে বেশ উপকারী।
২৪ তারিখ পালন করা হয়ে থাকবে আলোর উৎসবের সবচেয়ে আনন্দমুখর, কেন্দ্রীয় দিনটি। অর্থাৎ দীপাবলি (Diwali)। প্রত্যেক হিন্দুর বাড়ি সেজে উঠবে আলোর ছোঁয়ায়। ছোট থেকে বড় সকলে মেতে উঠবেন নানারকম বর্নময় বাজি ফাটানোর আনন্দে। আলোকের ঝর্ণাধারায় সকল মলিনতাকে ধুইয়ে দেওয়ার উদযাপনই হল দীপাবলির মূল ভিত।
আলোর উৎসবের শেষ দিন পালিত হয় গোবর্ধন উৎসব(Govardhan Utsav) । দেবরাজ ইন্দ্রের পুজো না করার রোষে তিনি বৃন্দাবনবাসীর ওপর ঘন বর্ষণ সৃষ্টি করেন। বৃন্দাবনকে বেষ্টন করে আছে গোবর্ধন পর্বত। ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃন্দাবনের। ইন্দ্র দেখতে চেয়েছিলেন, গোবর্ধন পর্বত কিভাবে তাঁর বাসিন্দাদের রক্ষা করেন। বিপদগ্রস্ত বৃন্দাবনবাসীর ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠেন কিন্তু গোবর্ধন পর্বতই। যদিও গোবর্ধন পর্বতের একার ভূমিকা তাতে ছিল না। জগতের ত্রাতা স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ তাঁর বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলি দিয়ে তুলে ধরেছিলেন গোবর্ধন পর্বতকে, আর তার নিচেই আশ্রয় পান পশু পাখিসহ আবালবৃদ্ধবনিতা এমনকি কিন্নরেরাও। পরাজয় ঘটে দেবরাজের আত্ম অভিমানের। এই বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পালন করা হয়ে থাকে গোবর্ধন উৎসব। ২৫ অক্টোবর ভারতবাসী এই উৎসবে ব্রতী হবেন।